ফটোগ্রাফারদের যা করা উচিত – শফিউল

ফটোগ্রাফী নিয়ে সব সময় অন্য ফটোগ্রাফাররা একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হন তা হল, ভাইয়া/আপু, আমি কি করব? এবং এই ফটোগ্রাফার ভাইয়া আপুরা সব সময় টিপস দিতেই থাকেন কি করতে হবে কি করতে হবে। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই চিন্তা করি না যে কি কি করা উচিত না। এখানে যেই টিপস গুলি দেওয়া আছে, তার কোনটাই না করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। আর এটা বেশী কাজে লাগবে নতুন ফটোগ্রাফারদের জন্য। পুরাতন ফটোগ্রাফাররা পড়ে দেখতে পারেন, কোন ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন, আর নিজের ভূল থাকলে শুধরে নিবেন।

১. চাই আরও আরও লেন্স, ট্রাইপড, ফ্লাস ইত্যাদি ইত্যাদি:

বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা থাকে যে যত বেশি গিয়ার, তত বেশী ভাল ছবি। আর নতুনদের তো আফসোসের শেষ নাই। প্রথমে একটা ক্যামেরা হাতে পাইলে চাই ডিএসএলআর, সেটা পাইলে চাই এত্তোগুলান লেন্স, তারপর চাই ফ্লাস, ট্রাইপড ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে ভাই ধীরে। যা হাতে আছে তাই দিয়ে কাজ শিখুন, আস্তে আস্তে আগান। কাজ যত শিখবেন, ততই নিজে নিজে বুঝতে পারবেন যে আপনার কি দরকার। সত্য কথা বলতে ১বছর আগে আমারও এমন মনে হত। কিন্তু আমার হাতে এখন যা আছে, আমি তাই নিয়েই সন্তুষ্ট। আর তা দিয়ে যে খারাপ কিছু করছি এমন না। বরং আমি উল্টা বলি যে আমি আমার ক্যামেরার যোগ্য এখনও হইনি।

Gear

২. ক্যামেরা বাড়ি রেখে যাওয়া:

একটু খানি, শুধু একটু খানি আলসেমি করে ঘরে ক্যামেরা রেখে বের হবেন, দেখবেন আপনার মাথার উপরে আকাশটা আজকে কত্তো সুন্দর দেখাচ্ছে। হয়ত এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যা আপনার হাতে ক্যামেরা থাকলে তুলে রাখতে পারতেন। কিন্তু আফসোস, আপনিতো আলসেমি করে ক্যামেরা ঘরে রেখে গেছেন। অথবা হয়ত ছিনতাইকারির ভয়েই ক্যামেরা রেখে গেছেন। কি আর করা, মিসতো মিসই। তাই না? তাই ক্যামেরা কখনই ঘরে ফেলে রেখে যাবেন না। সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।

৩. একই টেকনিকে সব ছবি তোলা:

নতুনদের ক্ষেত্রে এই জিনিষটা একটা কমন বিষয়। একবার যদি একটা জিনিষ ভাল পাওয়া যায়, তাইলেই হইছে, ঐভাবেই ছবি তুলতে থাকবে। অনেকই হয়ত মনে মনে আমার ভুল একটা ধরে ফেলছেন, মনে করছেন যে আসলে এমন হয় না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। চাঁদের ছবি দেখেছেন? দেখবেন সব্বাই একই রকম ছবি তুলে ভরে ফেলেছে। নতুনত্ব নেই কোন। সবার একই ছবি। বলতে বাধে না, আমিও অমন করেই তুলেছিলাম, মাত্র একবার। একবার তুলে যখনই ফেসবুকে আপলোড দিলাম, ওমনি ৩০ মিনিটের মধ্যে ঐ একই রকম ছবিতে ফেসবুক একাকার। তাই, একই স্টাইলের ছবি বার বার না। নতুন টেকনিক বের করুন।

৪. কপিরাইটের মূল্য না দেওয়া:

অনেককেই দেখি যে কপিরাইটের মূল্যই দেয় না। কিছু বললেই বলে, আরে কপি করুকতো, কার কি আসে যায়। কিন্তু না, এমনে যদি সব্বাই আপনার ছবি কপি করে, তাহলে আর আপনি কষ্ট করে ছবি তুলছেন কেন? আর ভবিষ্যতেই বা আপনি কি করবেন? তাই নিজের কপিরাইটের মূল্য দিন। মূল ছবি আপলোড করা থেকে বিরত থাকুন। বরং মূল ছবির একটা রেপ্লিকা (ছোট সাইজের ছবি) আপলোড করুন।

৫. অতিরিক্তমাত্রায় কপিরাইট কপিরাইট করা:

আগের পয়েন্টের থেকে এটা একটু সেল্ফ-কন্ট্রাডিক্টরি মনে হতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায় ফটোগ্রাফাররা তাদের ছবি এখানে ওখানে দিয়ে নিজের কপিরাইটের জন্য এত্তোগুলা কথা লিখেন। এটা করা উচিত না। তাতে মানুষ বিরক্ত হয়। আপনি ছোট সাইটের ছবি দিলেই অথবা লোগো বসিয়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান। আবার আপনি যদি মনে করেন যে আপনার ছবিটি চুরি হতে পারে, তাহলে সেটি কোথাও প্রকাশ করাই উচিত নয়, শুধুমাত্র যেখানে দরকার, সেখানে প্রকাশ করুন।

copyright-sign-chasing-guy

৬. সব কাজ হাতে নেওয়া:

অনেকেই আছেন, যারা কোন একটা বিষয়ে কিছু না জেনেই কাজ হাতে নিয়ে ফেলেন। আপনার হাতে কাজ এসেছে, আর তাই করতে হবে এমনটা মনে করবেন না। এতে করে হিতে বিপরিত হতে পারে। কাজ একবার লেজে-গোবরে হয়ে গেলে ঐ ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কোন দিন কাজ পাবেন না, এটা মাথায় রাখতে হবে। তাই আগে কাজ শিখুন, পরে কাজ করুন। কাজ আসলেই হাতে নিবেন না। কিছু টাকার থেকে রেপুটেশন অনেক বড় বিষয়।

৭. সব কিছু নিজে করা:

আপনি পারেন বলেই সব নিজেকেই করতে হবে এমন না। দরকার পড়লে সঠিক কাজের জন্য সঠিক লোক সাথে নিন। আপনি হয়ত একহাত দিয়ে ক্যামেরা আর এক হাতে রিফ্লেক্টর ধরে রাখতে চাইবেন, এটা কখনও কখনও সম্ভব হলেও তা করা উচিত না। আর সাথে এক-দুজন এসিস্টেন্ট নেওয়া বেশ ভাবেরই বিষয়। লাভ কম হোক, এতে করে আপনার রেপুটেশন একটু হলেও বাড়বে। বুঝতেই পারছেন যে এটা একটু যারা ফটোগ্রাফিতে নাম কামিয়ে কাজ পাচ্ছেন, এমন লোকদের জন্য টিপস।

don't do all by yourself

৮. নিজের জায়গা তৈরী না করা:

অনেকেই আলসেমি করে নিজের জায়গা তৈরী করতে পারে না। হয় সে মানুষের সাথে কথা বলে না, নিজের কাজ শেয়ার করেনা, অথবা হয়ত অন্যের কাজ দেখে না। কোন না কোন ভাবে আপনার জায়গা আপনাকেই তৈরী করে নিতে হবে। না হলে আপনি একসময় আর পাত্তা পাবেন না। অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করতেই হবে।

৯. হিসাব, হিসাব, হিসাব:

আপনার খরচ যদি অতিরিক্ত হয়, তাহলে সেটা কমাতে হবে। অল্প অল্প করে আগান। একগাদা খরচ করে বসে থাকার কোন মানে হয় না। ক্যামেরার ইকুয়িপমেন্টে জং না পড়লেও ফাঙ্গাস পড়ে, তাই কিনে বসিয়ে রেখে কোন লাভ নেই।

calculate-carbs

১০. আগে থাকতে সামনের প্লান না করা:

বেশির ভাগ ফটোগ্রাফারের আগে বাড়তে না পারার বড় কারণ হচ্ছে তাদের আগে থেকে কোন প্লান থাকে না। এখন থেকে ৬মাস, ১বছর, ৫বছর, ১০বছর পর কি হতে চায়, কি করতে চায় তা জানে না। সবাই স্বপ্ন দেখে বসে থাকে যে বড় ফটোগ্রাফার হবে, কিন্ত কত বড় সেই প্রশ্ন নিজেকেই করে না। তাই আগে থাকতে প্লান করুন, সেই প্লান অনুযায়ী কতদূর আগালেন তা যাচাই করুন, সেই অনুযায়ী চলুন।

১১. ব্লগিং  এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা:

অনেকেই আছেন যে মাত্র ১/২টা গ্রুপে ছবি শেয়ার করেই বসে থাকেন। বা শুধুমাত্র ফ্লিকারে ছবি আপলোড করে বসে থাকেন। এমনটা করা উচিত না। উচিত হল যত যায়গায় পারা তত যায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া। যতগুলো ব্লগ, ছবি শেয়ারিং সাইট, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি, সব খানে ছবি আপলোড করুন। মনে রাখবেন, হয়ত এমন একটি সাইটে ছবি আপলোড করলেন যেখানে বছরে ১জন ঢুকে, এমন যায়গায়ও শেয়ার করা উচিত। কারণ হয়ত ঐ ১জনই আপনার ছবিটি কিনতে পারে, বা আপনার ছবি দেখে আপনাকে কাজ দিতে পারে। আর তা না করলেও ঐ ১জনতো আপনার নাম জানল, তাই না?

socialmedia31

১২. নিজের ওয়েব সাইট:

অনেকেই মনে করেন যে নিজের ওয়েব সাইট থাকার দরকার নাই, আমি এতো বড় ফটোগ্রাফার হই নাই, আমি এত খরচ বহন করতে পারব না। কিন্তু নিজের ওয়েব সাইট থাকা গুরুত্ব পূর্ণ। ধরেন সবাই ফ্লিকারে বসে বসে আপনার সব ছবি এক সাথে দেখবে এমন নাও হতে পারে, আবার ফেসবুকে যার একাউন্ট নেই (এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম না) তারা কি করে আপনার ছবি দেখবে? তাই উচিত নিজের একটা ওয়েব সাইট থাকা। খরচ খুব একটা না, যেমন আমি নিজেই ১৫-২০ হাজার টাকায় ওয়েব সাইট তৈরী করে দেই। এটা আসলেই বড় কোন বিষয় না, কারণ এখানে আপনি ইচ্ছামত ছবি আপলোড, নিজের প্যাকেজ সমূহের বর্ণনা, নিজের পোর্টফলিও দেখান ইত্যাদি ইত্যাদি করতে পারবেন। তাই, এখনই একটা ওয়েব সাইট বানিয়ে নিন।

১৩. ট্রাইপড ভুলে যাওয়া:

এই জিনিষ এত বেশিই হয় যে এই গুরুত্বপূর্ণ লিষ্টে না ঢুকিয়ে পারলাম না। কম আলো, সন্ধা, রাত, ভোর এইসবের ক্ষেত্রে যেমন ট্রাইপড জরুরী, তেমনিই অন্য সব ক্ষেত্রেও ট্রাইপড জরুরী। এমনও হতে পারে যে এক জায়গায় গিয়ে আপনার প্যানারোমা শট নিতে ইচ্ছা হল, কিন্তু ট্রাইপডের অভাবে নিতে পারলেন না। তাই, কখনই ট্রাইপড ভুলে যাওয়া উচিত না, বা সাথে না নিয়ে ফটোগ্রাফী করতে যাওয়া উচিত না।

১৪. সব কিছু ফটোশপে ঠিক করে নিতে পারবেন এমন ভাবা:

এটা খুবই কমন যে একটা ছবি তুলেই চিন্তা করা যে এটা ফটোশপে ঠিক করে নিব। মনে রাখবেন, চিন্তা করার সময় সহজ মনে হলেও বেশীর ভাগ সময়ই ফটোশপে সব ঠিক করা এতটা সহজ না। তাই, ছবিটি ভাল করে আবার তুলুন, ফটোশপকে একটু ভুলে থাকলে উপকারই হবে, ক্ষতির সম্ভাবনা কমই আছে। এর একটা উদাহরণ নিচে দেখুন।

photoshop editing error

১৫. ফটোশপ বা ছবি এডিটিং সফ্টওয়্যারে স্কিল না বাড়ান:

ফটোগ্রাফী করতে গেলে কিছু হলেও কারেকশন আপনাকে করতেই হবে। আগের ফটোগ্রাফাররা করতেন ডার্ক রুমে, এখন আমরা করি ফটোশপ বা লাইটরুমে। তাই এই বিষয়ে কিছু বেসিক স্কিল আপনাকে বাড়াতেই হবে। না হলে মাঠে মারা যেতে পারেন।

১৬. শেখা বন্ধ করা:

এটা বেশ হাস্যকর হয়ে যাবে, কারণ বর্তমান সময়ের ফটোগ্রাফারদের একটা বড় সমস্যা হল তারা শিখতেই চায় না, আর শেখা বন্ধ করা। তবে এই মুহূর্তে আপনি যদি এই লেখা পড়তে থাকেন, তার অর্থ দাড়ায় আপনি শেখা বন্ধ করেন নি বা শিখছেন। তাই অনুরোধ, শেখা বন্ধ করবেন না। হয়ত একই জিনিষ বার বার শেখার ফলে আপনি নতুন কিছু পেতে পারেন, আর যা শিখেন নি, তা শিখে ফেলতে পারেন।

Header-Lens-Photographer

১৭. নতুন নতুন লেন্স ব্যবহার না করে পুরাতনটা নিয়ে পড়ে থাকা:

অনেকেই আছেন একবার একটা লেন্সে অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরে আর ঐ লেন্স থেকে সরতেই চান না। এটা ঠিক না। হয়ত আজকে আপনি ৫০মিমি এর লেন্সে ভাল ফিল করছেন, তার মানে এই নয় যে আপনি কখনই ৩৫মিমি এর লেন্স চেক করবেন না। হয়তো তাতে আরও ভাল কিছু পেতেন। আবার তাই বলে ১নং টিপসের এর মত লেন্স লেন্স করেন না।

আরও অনেক জিনিষই না করার মত আছে, কিন্তু এইগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশাকরি আপনারা ভাল করে ফটোগ্রাফী শিখবেন এবং করবেন। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানের ফটোগ্রাফী করে দেশকে নতুন ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন। আপনাদের ছবি, মন্তব্য, লাইক, শেয়ারের অপেক্ষায় আজকের টিপস এখানেই শেষ করছি।

তবে শেষ করবার আগে পোকাগ্রাফার শিশির রহমান এই লেখাটা শেয়ার না দিয়ে পারলাম না। নতুনদের কাজে দিবে।

এই লেখাটি আগে প্রকাশিত হয়েছে TechBlog.com.bd এর ফটোগ্রাফী ক্যাটেগরীতে তে।

Leave a Reply