কখনো কি এমন হয়েছে, যে সামনে এক বিস্তৃত দিগন্ত, অসামান্য দৃশ্য, আপনি আপনার ক্যামেরা টা বের করলেন, আবেগে উত্তেজনায় শাটার টিপলেন, এবং তারপর ডিস্প্লের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে গেলেন, কারণ সামনে যে সৌন্দর্য্য দেখা যাচ্ছে , ক্যামেরা তে তার কিছুই আসে নি?
অথবা অন্য কোন ফটোগ্রাফারের ছবি দেখে কখনো মনে হয়েছে, যে কেন তাদের ছবি বাস্তব দৃশ্য টার চেয়েও এত্তগুলা সুন্দর আসে? তারপর মনে মনে ভেবেছেন, “ফটোশপ, সব ফটোশপ!!!”
যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আপনার ক্যামেরার “চোখ” কিভাবে “দেখে”, তাহলে মনে হয় এর উত্তরটা সহজেই পাবেন। আমরা আজ আলোচনা করব যে কিভাবে ক্যামেরা আমাদের চোখের চেয়ে ভিন্ন ভাবে কাজ করে।
কখন ক্যামেরার “চোখ” আপনার চোখের চেয়ে ভাল ?
.যে সব ক্ষেত্রে ক্যামেরা আমাদের চোখের চেয়েও ভাল কাজ করে সেগুলো হল
লো লাইট লেভেল
লো লাইটে সাধারনত আমাদের চোখ রঙএর প্রতি কম সেনসিটিভ। যারা বায়োলজি পড়েছেন তারা জানেন আমাদের চোখে কম আলো ও বেশী আলো তে দেখার জন্য দুইটী আলাদা আলাদা সেল আছে। একটি রড সেল, আরেকটি কোণ সেল। কিন্তু ক্যামেরার ক্ষেত্রে তো সেন্সর একটি ই, তাই সব সময় সেনসিটিভিটী একই রকম থাকে। তাই বাস্তবে ও লাইট কন্ডিশনে আমরা যতটুকু রঙ দেখি, ক্যামেরায় ছবি তুললে তার চেয়ে রঙ বেশী ধরা পড়ে।
এই ছবি টা আমার বাসার ছাদ থেকে তোলা, যখন তুলেছিলাম ,তখন খালি চোখে আকাশে এত বেশী সুন্দর রঙ দেখা যাচ্ছিল না।
বনানী ব্রিজের ওপরে তোলা এই ছবিটাতেও আকাশের রঙ খালি চোখে প্রায় অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল।
লং এক্সপোজার
এটা সম্পর্কে কমবেশী সবারই ধারনা আছে। যতক্ষন শাটার খোলা থাকবে ততক্ষন আলো ক্যামেরার ভিতরে ঢুকবে ও সেন্সরের উপরে পড়বে। ফলে লং এক্সপোজার শটে অনেক আকাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেইল ধরা পড়বে যা খালি চোখে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকার পরেও ধরা পড়বে না।
উপরের ছবিটি দোলন ভাই এর তোলা, ঊনার গ্রামের বাড়িতে। ২০ সেকেন্ডের এই এক্সপোজারে খালি চোখে যে পরিমান তারা দেখা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি তারা দেখা যাচ্ছে।
আবার লং এক্সপোজার আমাদের সময় বয়ে চলার একটা ধারনা দিতে পারে যা আমরা কখনই খালি চোখে দেখতে পারি না।
এই ছবি টাও দোলন ভাই এর তোলা। ২৫ সেকেন্ডের এক্সপোজারে ৯৭ টা ছবি তুলে এই ছবি টি তৈরী হয়েছে.
এই ছবিটা দার্জিলিং এ রক গার্ডেনে আমার তোলা। ১ সেকেন্ডের এক্সপোজারে তোলার কারণে পানিতে এমন একটা ফ্লোইং ভাব এসেছে।
শর্ট এক্সপোজার
ঠিক বিপরীত ভাবে, শর্ট এক্সপোজার বা হাই স্পিড ফটোগ্রাফি মোশন কে ফিক্স করে ফেলে। ফলে অতি তাড়াতাড়ি ঘটে যাবার ফলে আমাদের চোখে যেসব ঘটনা মিস হয়ে যায়, আমরা সেগুলো দেখার সুযোগ পাই।
এই ছবিটি আমার কাজিন এহসানুল কবির অভি এর তোলা। এই ছবিটি ১/২৫০ শাটার স্পিডে তোলা। ফলে পানির ফোটা গুলো ফ্রিজ হয়ে গেছে।
ডেপথ অফ ফিল্ড
এই জিনিসটার ক্ষেত্রে মানুষের চোখ এবং ক্যামেরার কিছুটা মিল আছে। যেমন, যদি আপনি এই লাইনের মাঝের কোন শব্দের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন এবং চোখ কোন ভাবেই না নড়ান, তাহলে আপনি অনুভব করতে পারবেন যে অন্য শব্দ গুলো আপনি ববুঝতে পারছেন, কিন্তু তা অই শব্দ টার মত স্পষ্ট নয়।অর্থাৎ যে শব্দ টা স্পষ্ট সেইটা আপনার ফোকাস, আর বাকিগুলো আউট অফ ফোকাস।
চোখের ক্ষেত্রে আপনি যখন আউট অফ ফোকাস এরিয়া তে তাকাবেন সাথে সাথে সেটা ফোকাস হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি যখন কম্পিউটারের বা প্রিন্ট করা কোন ছবির দিকে তাকান, তাহলে তার আউট অফ ফোকাস জায়গা টা কিন্তু পরিস্কার হয়ে যাবে না। ঠিক এই কারণে যেসব ছবির ডেপথ অফ ফীল্ড শ্যালো, সেগুলো দেখতে আমাদের কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। (আমার এক ফ্রেন্ড আছে, তার মতে তার মোবাইলের ক্যামেরা টা অনেক ভাল, কারণ পিছে ঘোলাঘোলা হয়)। নীচের ছবিটা শাহাদত হোসেন ভাই এর একটা শ্যালো ডেপথ অফ ফীল্ডে তোলা ছবি।
রঙ
অল্প কিছু কালার ব্লাইন্ড মানুষ ছাড়া আমরা আমাদের আশেপাশে যা কিছু দেখি সবই রঙ্গীন। আমরা রঙ্গীন দেখেই অভ্যস্ত। এই কারণে অনেকের কাছে সাদাকালো ছবি খুবই ইন্টারেস্টিং, আবার অনেকের কাছে অনভ্যস্ততার জন্য অপছন্দনীয়। বর্তমানে এই বিভিন্ন রঙ বা টোনে ছবি তোলার সুবিধার কারণে ফটোগ্রাফি আমাদের কোন কিছু দেখার ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা এনে দিয়েছে।
উপরের ছবিটা এহসানুল কবির অভি এর তোলা, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার Walhalla শহরে।
কখন আপনার চোখ ক্যামেরা চোখের চেয়ে ভাল!!
ডায়নামিক রেঞ্জ
আমরা যখন কোন কিছু দেখি, তখন চোখ এবং মস্তিস্ক একসাথেই কাজ করে, ফলে অনেক অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরী হয় যা হয়ত বাস্তবে নেই। পিচের রাস্তায় চলার সময় দূরের মরিচীকা ঠিক এমনি একটা জিনিস।
আমাদের চোখ আশে পাশের আলোর পরিবর্তনের সাথে খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে, ফলে আমাদের দেখতে কোন অসুবিধা হয় না। যেমন আমরা কোন পাহাড়ী এলাকায় যখন দেখি তখন সেখানে হাইলাইট আর শ্যাডো দুইরকম জিনিসই অনেক পরিমানে থাকে। আমার চোখ যে অংশে যায়, ব্রেন সাথে সাথে কত টুকু আলো ঢুকলে সেই জায়গার ডিটেল আমি দেখতে পাব, সেই মাপে চোখ অ্যাডজাস্ট করে ফেলে। মনে হয় যেন আমাদের ব্রেন ক্রমাগত অনেকগুলো স্ন্যাপশট নিয়ে সেগুলো কম্বাইন করে আমাদের একটা দৃশ্য দেখায়।
আমাদের ক্যামেরা কিন্তু এইভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। সে একটি নির্দিষ্ট সেটিং এ সেন্সরে যেটুকু লাইট পড়ে, কেবল সেটারই একটা এক্সপোজার নিতে পারে। তাহলে যা দেখেছি ঠিক সেভাবে ছবি নেবার উপায় কি?
এখানেই আসে এক্সপোজার ব্লেন্ডিং বা হাই ডাইনামিক রেঞ্জ (এইচডীআর) ফটোগ্রাফি, যার মাধ্যমে আমরা যে পরিমান ডিটেল দেখেছি সেই পরিমান, বা কখনো কখনো তার চেয়ে বেশী ডীটেইল ছবি দেখার জন্য ব্যাবহৃত হয়। আমরা সাধারন ভাবে যা ডিটেইল দেখি, তার চেয়ে বেশী যদি দেখানো হয় , তাহলে ছবি টা অনেক সময় রিয়ালিস্টিক লাগে না। তবে এক্ষেত্রে ভুল বলে কিছু নাই। এইটা সম্পুর্ন আপনার স্বাধীনতা যে আপনি আপনার ছবি কেমন দেখাতে চান। বাস্তবসম্মত ও দেখাতে পারেন, আবার সারিয়ালিস্টিক ও দেখাতে পারেন।.
উপরের ছবিতে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে এই ছবিটা আসলে তিনটা ভিন্ন এক্সপোজারে তোলা হয়েছে। একটা শ্যাডোর ডিটেলের জন্য, একটা মিডটোনের জন্য, আরেকটা হাইলাইটের জন্য।
(দার্জিলিং টি এস্টেট থেকে সিকিমের দেখা যাওয়া কিছু অংশ।)
আমাদের ব্রেইন যা কাজ টা অটোমেটিক করে, আমি সেই কাজটা এডোব ফটোশপে নিয়ে এক্সপোজার ব্লেন্ড করে এমন করেছি। আমার মেমরি তে সেই সময় যেমন দেখা যাচ্ছিল তেমনটী ই করতে চেষ্টা করেছি।
পরিশিষ্ট
ছবি “ভাল” হওয়া টা মানুষ থেকে মানুষে ভ্যারি করে। কেউ চায় সে খালি চোখে যেভাবে দেখেছে, সেই ভাবেই ছবি তে আসতে হবে, কেউ আবার চায় যেভাবে তার চোখ দেখতে পারে না, যেমন সাদাকালো, লং এক্সপোজার বা অনেক ডিটেইল ওয়ালা এইচডিআর ছবি দেখতে।
তবে আপনি যদি জানেন যে কিভাবে আপনার ক্যামেরা দেখে, তাহলে আপনি যেভাবে দেখতে চান সেভাবেই ছবি তুলতে পারবেন। হ্যাপী ক্লিকিং।
অনেক ভাল লিখেছেন ডেমিয়েন থর্ন। Thank You <3
ধন্যবাদ প্রীতম
Thank you
আপনাকেও ধন্যবাদ
এক কথায় অসাধারণ হয়েছে স্যার… ভবিষ্যতে কিছু জানতে চাইলেও এই লেখাটা সাহায্য করবে আশা করি…অনেক ধন্যবাদ।
😀
লেখা ভালো হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ
অসাধারণ … অনেক ভালো লাগলো লেখা টা …
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
অনেক ভাল লিখেছেন স্যার, আরো কিছুর জন্য অপেক্ষায় রইলাম
আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আরো কিছু লেখা দিতে পারব।
অসম্ভব সুন্দর একটি লেখা। প্রতিনিয়ত আমি নতুন কিছু শিখতে পেলে খুব ভালো লাগে। এখান থেকেও আমি শিখলাম। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
Great Write up…
thank you … the tutorials are really helpful 🙂
সাধারন ডিজিটাল ক্যামেরাতে ডেপথ অব ফিল্ড ইফেক্ট আসে না কেন????