আমাদের মিকেল এ্যান্জেলো : ইউজিন স্মিথ – শামীম শরীফ সুষম

লেখা পড়ার আগে , লেখার শিরোনাম পড়ে ভয় খাইতেছেন ? ইউজিন স্মিথ ?? এইডা আবার কেডা …. সে কি ফটোগ্রাফার ? তার কি ডি এস এল আর আছে ? সে কি ব্যাকগ্রাউন্ড ঘোলা করতে পারে ??

এইসব প্রশ্নে উত্তর দেয়া আমার জন্য কঠিন । ইউজিন স্মিথ নিজেই এক রহস্যময় মানুষ । রহস্যময় তার জীবন , তার কাজ …. তবে দুনিয়ার এতো ফটোগ্রাফার থাকতে তাকে নিয়া লেখার একটা বিশাল কারণ রয়েছে … কারণটা সহজ …. এই ভদ্রলোক দুনিয়ার অন্যতম Underrated এবং রহস্যাবৃত ফটোগ্রাফারদের একজন ।

Masters Of Photography …নামের একটা ডকুমেন্টারি দেখতেসিলাম বছর দুয়েক আগে …. হঠাৎ কিভাবে যেন উঠে এল এক আজব ফটোগ্রাফারের কথা …. যুদ্ধের ছবি তুলতে গিয়ে গুলির আঘাতে বাম হাত আর মুখের কিয়দাংশ বিসর্জন দিতে হয়েছিল যাকে … তবুও প্লাস্টিক সার্জারি করে আবার তিনি ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত …. তখনই কৌতুহল জেগেছিলো , পরে তার ছবি দেখে কৌতুহল পরিণত হয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় …

চিন্তা করুণ , আপনি একজন ছাপোষা ফটোসাংবাদিক , আপনার বস আপনাকে হুকুম দিলো অমুক জায়গায় গিয়া তিনসপ্তা থাকো , তারপর শখানেক ছবি তুইলা নিয়া আসো …. আপনি কি করবেন ?

আপনি কি করবেন এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই , কিন্তু ইউজিন স্মিথকে যখন ম্যাগনাম থেকে পিটসবার্গের জীবন নিয়ে তিনসপ্তাহ ছবি তুলতে বলা হয় , তিনি সেখানে থাকেন তিন বছর ….. তার মনে হয়েছিলো , পিটসবার্গের জীবনকে শাটারের ছন্দে বেঁধে ফেলার জন্য তিন বছর অন্ত:ত প্রয়োজন …. আরএ প্রচেষ্টায় তিনি কতোগুলো শট নিয়েছিলেন জানেন ?? মাত্র দশ হাজার !!

ইউজিন স্মিথের পুরো নাম উইলিয়াম ইউজিন স্মিথ । জন্ম ১৯১৮ সালে , ক্যানসাসে … মৃত্যু ১৯৭৮ সালে, নিউইয়র্কে । মাত্র ৬০ বছরের জীবনে তার অসামান্য ছবিগুলি তাকে অমর করে রাখবে চিরকাল । তাকে বলা হয় The Father Of Photo Essay । এই বিশেষ ধারাটির প্রবর্তন ও প্রজ্জ্বলন হয়েছে তারই নিপুণ হাতে ।

Photo-1ইউজিন স্মিথের ছবি তোলার শুরু ছেলেবেলাতেই , স্পোর্টস , ক্যানসাসের ধূলিঝড় আর এ্যারোপ্লেন ছিলো তার ছবির প্রধান বিষয় তখন । তারপরে নিউজউইক পত্রিকায় চাকুরি …. আর ব্যাপক সমালোচনার শিকার পাগলাটে পারফেকশনিজম আর তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের জন্য । তবুও চাকুরি চলছিলো …কিন্তু এরই মাঝে আবারও জিদ , মিডিয়াম ফর্মেটে ছবি তুলবেন না তিনি , ৩৫মিমি দরকার তার …. ফলাফল- চাকরিচ্যূতি ।

আর এরমাঝেই ছিলো তারজন্য অসীম সম্ভাবনা .. তিনি যোগ দিলেন বিখ্যাত “লাইফ” ম্যাগাজিনে , তার ফ্রেমে উঠে এল ভয়াবহ ওকিনাওয়ার যুদ্ধ … মার্কিন সৈন্যের হাতে গুলিবিদ্ধ সদ্যেজাত জাপানী শিশু …. প্রার্থনারত আহত সৈনিক …. আর এরই ফলাফল দাঁড়াল হাতে আর চোয়ালে এস মর্টার স্প্রিন্ট লাগা … প্রায় এক বছর হাসপাতালে পঙ্গু জীবন … তারপর আবার অদম্য উৎসাহে ৩৫মিমি নিয়ে পথচলা ।

 

 

Photo-2

এরপর তার হাতে জন্ম হয় এক নতুন বিষয়ের – ফটো এসে । একজন মানুষের গল্প নিয়ে একএকটি ফটোগ্রাফিক ক্লাসিক সিরিজ …. সেখানে সাবজেক্ট কখনো গ্রাম্য চিকিৎসক , কখনো স্পেনের ছোট্ট কোন শহর । আর এখানেই মাথায় বীজ বপন তার অভিনব পিটসবার্গ প্রোজেক্টের – একজন সময়ের চেয়ে অগ্রসর মানুষের চোখে একটি শহর ।

Photo-3

এই কাজগুলি তাকে বিখ্যাত করে তোলে … ১৯৫৫ সালে ম্যাগনাম ফটো এজেন্সিতে যোগদান …তার সম্পাদক স্তেফান লোরান্ট এর আগ্রহে শুরু হয় পিটসবার্গ প্রজেক্ট – সময় তিন সপ্তাহ ।
তিন সপ্তাহ চলে যায় , স্মিথ ফেরেন না …. তার চোখ বলে , এখনো অনেক বাকি ..এখনো অনেক বাকি । প্রজেক্ট শেষ করতে তিন বছর লেগে যায় … স্মিথ ফেরেন দশ হাজার নেগেটিভ নিয়ে ।

Photo-4

তার এ বিশাল কাজ তার জীবদ্দশায় মূলত অপ্রকাশিতই ছিল । তার মৃত্যুর পরে আজও যখন আমরা পিটসবার্গের ছবিগুলো দেখি , মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছুই থাকে না।

আর তারপর তার জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ – মার্কারী পয়জনিং এর ফলে জাপানে “মিনামাটা” রোগ নিয়ে তার জগদ্বিখ্যাত ছবি “ টমোকো ইমুরা ইন হার বাথ” , যাকে তুলনা করা হয় মিকেলএ্যান্জেলোর “পিয়েতা”র সাথে ….. মায়ের কোলে মার্কারী বিষক্রিয়ায় ভয়াবহ বিকৃত , নগ্ন শিশু ….. বিশ্ব চমকে ওঠে সাদাকালো এই ছবির জোরালো বক্তব্যে , বন্ধ হয় মার্কারি বিষক্রিয়া ।

মৃত্যুর পরে অমর এই ছবিটি স্মিথ পরিবারকে এনে দিতে পারতো অসীম বৈভব , কিন্তু ইউজিন স্মিথের স্ত্রী চাননি একটি পরিবারের দু:খকে উপজীব্য করতে , তিনি ছবিটির মূল কপি সেই জাপানী পরিবারকে ফিরিয়ে দেন ।

আজও ইউজিন স্মিথ ফাউন্ডেশন সম্মানিত করে চলেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ “মানবিক” ফটোগ্রাফারকে । আর আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এর পেছনের মানুষটিকে – উইলিয়াম ইউজিন স্মিথ : আমাদের মিকেলএ্যান্জেলো ।

One thought on “আমাদের মিকেল এ্যান্জেলো : ইউজিন স্মিথ – শামীম শরীফ সুষম

Leave a Reply