বলা হয় যে মিররলেসের যুগ আসছে। এক সময় ডিএসএলআর আর থাকবেনা। কথাটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। বড় কোম্পানিগুলো নতুন ডিএসএলআর হয়তো আর বানাবে না, বা খুব কম বানাবে। তোমরা যারা এখনো ডিএসএলআর ইউজ করছ বা নতুন ক্যামেরা কেনার কথা ভাবছ তারা কি করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বুঝার চেষ্টা করি মিররলেসস এবং ডিএসএলআর কিভাবে কাজ করে।
ডিজিটাল যুগ আসার আগে আমরা ফিল্ম ইউজ করতাম। ফিল্মের একটা বিশেষত্ব হল যে ফিল্মে একবার আলো পড়লে ফিল্ম এক্সপোজড হয়ে যায় এবং সেই ফিল্ম ছবি তোলার জন্য আর ব্যাবহার করা যায়না। তাই ফিল্মকে ছবি তোলার মুহূর্ত ছাড়া অন্য সময় অন্ধকারে রাখতে হয়। এই কারণে ছবি তোলার আগে ভিউফাইন্ডার দিয়ে দৃশ্য দেখার জন্য আয়না বা মিররের ব্যবস্থা করা হয়। নিচের ছবিতে দেখ।
এক। আলোর পথে ৪৫ ডিগ্রীতে একটা আয়না আছে। এটা হচ্ছে মেইন আয়না। লেন্সের ভিতর দিয়ে আসা আলো এই আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে উপরের দিকে যায়। উপরে এই আলো আবার প্রতিফলিত হয় পেন্টামিরর (পাঁচটা আয়না) বা পেন্টাপ্রিজম দিয়ে এবং প্রতিফলিত আলোর একটা অংশ ভিউফাইন্ডার দিয়ে আমাদের চোখে প্রবেশ করে, আমরা দৃশ্য দেখতে পাই। এই দেখা তাৎক্ষণিক, অর্থাৎ আলো লেন্সের ভিতর দিয়ে প্রবেশের সাথে সাথে আমরা দৃশ্য দেখি। খালি চোখে দৃশ্য দেখার সাথে এটার কোন পার্থক্য নেই।
দুই। মেইন আয়নার পিছনে আছে আরেকটা আয়না যেটাকে সেকেন্ডারি আয়না বলা হয় (দ্বিতীয় ছবি)। মেইন আয়নার মাঝের কিছুটা অংশ থাকে ট্রান্সলুসেন্ট, অর্থাৎ এই অংশে পতিত আলোর কিছুটা প্রতিফলিত হয় এবং কিছুটা প্রতিফলিত না হয়ে সেকেন্ডারি আয়নায় গিয়ে পড়ে। এরপর সেকেন্ডারি আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে অটোফোকাস সেন্সরের (AF sensor) উপর পড়ে। এই সেন্সরের মাধ্যমে হিসাব নিকাশ করে ক্যামেরা অটো ফোকাসের জন্য লেন্সের পজিশন ঠিক করে।
তিন। পেন্টামিরর থেকে প্রতিফলিত আলোর কিছুটা অটোএক্সপোজার সেন্সরে (AE sensor) পড়ে। এই সেন্সর দিয়ে মিটারিং করা হয়। কিছু ক্যামেরায় এই সেন্সরে পাওয়া তথ্য অটোফোকাসেও কাজে লাগানো হয়।
মিররলেস ক্যামেরায় আয়না থাকেনা। উপরের তিনটা কাজের জন্য ক্যামেরার ইমেজ সেন্সর ইউজ করা হয়। এটা সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে ফিল্মের মতো সেন্সরে আলো পড়লেই সেন্সর এক্সপোজড হয়না, সেন্সরকে প্রয়োজন মতো যেকোনো সময় এক্সপোজ করা যায় (অর্থাৎ ঠিক সেই সময়ে যখন তুমি শাটার টিপো)।
এবার দেখা যাক ডিএসএলআর ও মিররলেসের পার্থক্য ও মিল কি কি।
১। আয়না থাকেনা বলে মিররলেস ক্যামেরা ছোট ও হালকা করা যায়। ছোট ও হালকা অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক, আবার অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক নয়। যেমন খুব বড় লেন্সের সাথে ছোট ক্যামেরা দিয়ে সহজে ব্যালেন্স করা যায়না। তাছাড়া ক্যামেরা ছোট হলে অনেক সময় ধরতে অসুবিধা হয়, এবং বাটনগুলো ঘিঞ্জি হয়ে যায়।
২। লেন্সের সাইজ ও ওজনঃ মূলত নির্ভর করে সেন্সরের সাইজের উপর। এই কারণে ডিএসএলআর ও মিররলেস ক্যামেরার লেন্সের সাইজ ও ওজনে তেমন পার্থক্য দেখা যায়না।
৩। অটোফোকাসঃ
ক) মিররলেসে যে সেন্সর দিয়ে ছবি তোলা হয় সেই সেন্সর দিয়ে অটোফোকাস করা হয়। এই কারণে অটোফোকাস ডিএসএলআরের চেয়ে নিখুঁত হয়। লেন্সের জন্য আলাদা ভাবে মাইক্রো এডজাস্টমেন্ট করতে হয়না।
খ) ফ্রেম রেটঃ ডিএসএলআরে প্রতিটা ছবি তোলার আগে আয়নাকে আলোর পথ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় যাতে করে আলো সেন্সরে পড়তে পারে এবং পরের ছবি তোলার আগে আয়নাকে আবার আগের পজিশনে আনা হয় যাতে করে আমরা দৃশ্য দেখতে পারি ছবি তোলার আগে। আয়না একটা নির্দিষ্ট সময়ে কয়বার এভাবে উঠানামা করতে পারবে তার একটা সীমা আছে। ক্যানন এবং নিকনের সবচেয়ে ভালো ক্যামেরা এটা করতে পারে সেকেন্ডে ১৪-১৬ বার যখন ভিউফাইন্ডার দিয়ে ছবি তোলা হয়।
আয়নার উঠানামা ছাড়াও শাটারের উঠানামার একটা সীমা আছে। ক্যাননের 1DX III তে এটা সেকেন্ডে ২০ বার করা যায়।
মিররলেসে উপরের সীমাবদ্ধতাগুলো নেই। ইলেকট্রনিক শাটার ইউজ করে ফ্রেম রেট অনেক বেশি করা যায়। ডিএসএলআরেও এটা করা যায় যদি ভিউফাইন্ডার ইউজ না করে পিছনের এলসিডি দিয়ে ছবি তোলা হয়, এ ক্ষেত্রে আয়না উঠিয়ে রাখা হয়, বারবার উঠানামা করার দরকার হয়না। কিন্তু শুধু পিছনের এলসিডি দিয়ে হাই ফ্রেম রেটে ছবি তোলা খুব কঠিন।
প্রশ্ন হল এতো বেশি ফ্রেম রেট দরকার আছে কিনা। খুব সম্ভবত ৯৯% ফটোগ্রাফারের দরকার নেই।
গ) ইমেজ সেন্সর অটোফোকাস সেন্সরের চেয়ে অনেক বড়। এই কারণে মিররলেসে অনেক কম আলোয় অটোফোকাস করা যায় যা ডিএসএলআরে অসম্ভব। তারমানে এই নয় যে ডিএসএলআর এ বিষয়ে খুব খারাপ।
ঘ) অটোফোকাস সেন্সর ছোট হওয়ার কারণে ফোকাস পয়েন্টগুলো দৃশ্যের মাঝামাঝি থাকে, পুরো দৃশ্য বা পুরো ফ্রেম কাভার করেনা। সব না হলেও কিছু মিররলেসস ক্যামেরায় ফোকাস পয়েন্ট পুরো ফ্রেম কাভার করে।
৪। ম্যানুয়াল ফোকাসঃ মিররলেসে কিছু ক্যামেরায় এটা করার জন্য ফোকাস গাইড, জিব্রা ইত্যাদি ব্যাবহার করা যায়। এতে করে ম্যানুয়াল ফোকাস করতে বেশ সুবিধা হয়।
৫। এক্সপোজার সিমুলেশনঃ ছবির উজ্জ্বলতা কেমন হবে, ছবি দেখতে কেমন হবে, তা ছবি তোলার আগেই বুঝা যায়। ডিএসএলআরে ভিউফাইন্ডার ইউজ করে এটা করা যায়না, লাইভ মোড বা পিছনের এলসিডি দিয়ে ছবি তোলার সময় করা যায়। বিশেষ করে কম আলোয় ছবি তুলতে এটা বেশ কাজে দেয়।
৬। ভিউফাইন্ডার ল্যাগঃ ডিএসএলআরে একটা মনিটর থাকে, পিছনের এলসিডি, ছবি তোলার জন্য এটা কম ইউজ করা হয়। যেসব মিররলেসে ভিউফাইন্ডার আছে সেখানে দুটো মনিটর থাকে, পিছনের এলসিডি ও ভিউফাইন্ডার মনিটর। ইমেজ সেন্সর থেকে প্রসেস করে এই দুই মনিটরে ছবি দেখানো হয়। এই প্রসেসিং এ কিছুটা সময় লাগে। তাই ডিএসএলআরের মতো তাৎক্ষণিক ভাবে দৃশ্য আমরা ভিউফাইন্ডারে দেখিনা, একটু পরে দেখি। আধুনিক কিছু ক্যামেরায় এই প্রসেসিং এতো তাড়াতাড়ি করা হয় যে এই ল্যাগ বা দেরি বুঝা যায়না। এটা দিন দিন উন্নত হচ্ছে।
৭। ভিউফাইন্ডার ব্ল্যাকআউটঃ যখন খুব হাই ফ্রেম রেটে ছবি তোলা হয় তখন আয়নার উঠানামা ও শাটারের উঠানামার কারণে দুই ছবির মাঝামাঝি কিছু সময় আমরা ভিউফাইন্ডারে কিছুই দেখিনা। অল্প কয়েকটা মিররলেসে খুব দ্রুত প্রসেসিং করে এই ব্ল্যাকআউট দূর করা হয়েছে, অর্থাৎ ভিউফাইন্ডারে কোন গ্যাপ ছাড়াই দৃশ্য দেখা যায়। এক সময় সব মিররলেসেই এটা আসবে আশা করা যায়।
৮। আইবিস (IBIS): ক্যামেরার নড়াচড়া, বিশেষ করে কম শাটার স্পীডে, ছবি কম শার্প বা ব্লারি করতে পারে। এই পদ্ধতিতে সেন্সর ক্যামেরা বা লেন্সের নড়াচড়ার উলটো দিকে মুভ করে ছবি স্থির রাখা হয়। কম আলোয় ছবি তোলার জন্য এটা খুব কাজে দেয়। এই কাজটি অনেক বছর ধরে শুধু লেন্সের গ্লাস মুভ করে করা হতো, কিন্তু সব লেন্সে এই ফিচার ছিলোনা। যদিও এই ফিচার ডিএসএলআরেও দেয়া যায়, ক্যানন ও নিকনের কোন ডিএসএলআরে এই ফিচার নেই, অধিকাংশ মিররলেসে এটা আছে।
৯। চেহারা ও চোখের অটোফোকাসঃ এটা শুধু কিছু মিররলেসে আছে। ক্যামেরা চেহারা বা চোখ চিনতে পারে এবং প্রায় নির্ভুল ভাবে চেহারা বা চোখে ফোকাস করতে পারে। প্রায় নির্ভুল ভাবে বলছি এই কারণে যে ক্যামেরা অনেক সময় চোখের মনিতে ফোকাস না করে ভ্রূতে করে। সময়ের সাথে এটা নিখুঁত হচ্ছে। এর ফলে শুধু যে ফোকাসে সুবিধা হয় তা না, ছবি ফ্রেম বা কম্পোজ করতে অনেক সুবিধা হয়।
১০। ছবির মানঃ কোন পার্থক্য নেই।
১১। ব্যাটারি লাইফঃ ডিএসএলআর অনেক বেটার, যদিও মিররলেস আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।
১২। কয়েকটা মিররলেসস ক্যামেরা এই ব্যাপারে ডিএসএলআরের চেয়ে অনেক ভালো।
তোমরা কি করবে?
তোমরা কি করবে তা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করবে, যেমন কেন ফটোগ্রাফি করো, সামর্থ্য কেমন, শখ না পেশা ইত্যাদি। তবে সাধারণ ভাবে বলা যায়ঃ
১। যারা ডিএসএলআর ইউজ করছ এবং কোন সমস্যা হচ্ছেনা তাদের মিররলেস কেনার দরকার নেই।
২। যারা ডিএসএলআর ইউজ করছ কিন্তু ক্যামেরা বা লেন্সে সমস্যা হচ্ছে তারা নতুন ডিএসএলআর কিনতে পারো কারণ এখন অনেক কম দামে খুব ভালো ডিএসএলআর ( যেমন 5DIV, D850, D500) কিনতে পাওয়া যায়। বেশীর ভাগ ফটোগ্রাফার এখনো ডিএসএলআর ইউজ করে এবং এটার এক্সেসরিজ অনেক বেশি পাওয়া যায়।
৩। যারা নতুন ফটোগ্রাফি শুরু করছ তারা ডিএসএলআর বা মিররলেস যেকোনো দিকেই যেতে পারো। এটা বলছি এ কারণে যে মিররলেস আরো উন্নত হবে, দাম কমে আসবে, তাই পরে কেনার পক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু আমরা উপরে দেখেছি মিররলেসের অনেক সুবিধা আছে, এখন মিররলেস কিনলে সেসব সুবিধা ভোগ করা যাবে। তাছাড়া এখন মিররলেস কিনলে পরে মিররলেসে সুইচ করার ঝামেলা থাকবে না।
গিয়ারের চেয়ে ফটোগ্রাফার ইম্পরট্যান্ট এই কথাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য।