একটা সময় বলা হত যে ঢাকা শহরে যত কাক, তার সমান সংখ্যায় আছে কবি, আর এখন বলা হয়, এই যে ঢাকা শহরে যত কবি, তাদের মাথার চুলের সমান সংখ্যায় আছে ফটোগ্রাফার! কথাটা ফটোগ্রাফার হিসাবে এক অর্থে অপমানজনক, আবার আর এক অর্থে কথাটা সম্মানজনকও। অপমানজনক এই জন্য যে, এখন যে সে ফটোগ্রাফার সাজে। আর সম্মানজনক এই জন্য যে একসময় ক্যামেরা হাতের মানুষ গুলিকে নিতান্তই ভাড়া করা বা পেইড লোক মনে করা হত, এখন সম্মান বাড়ছে।
যাই হোক, আসি মূল কথায়। এতো এতো ফটোগ্রাফারদের মধ্যে কি করে আপনি জায়গা করে নিবেন? উপায় সহজ। বেশির ভাগ ফটোগ্রাফার খালি ছবিই তুলে, পড়ে না, বা শুনে না। একজন ভাল ফটোগ্রাফার হতে হলে আপনাকে ধৈর্য্য থাকতে হবে। থাকতে হবে পড়ার ও সেই মতে চেষ্টা করার ইচ্ছা। আর এই জন্যই আমার এই ছোট্ট ১০টি টিপস নিয়ে হাজির হওয়া। যার প্রায় সব গুলিই নতুন যারা ফটোগ্রাফীতে আগ্রহী তাদের কাজে দিবে। এক্সপার্টদের খুব কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না।
১. রুল অফ থার্ডঃ
ফটোগ্রাফীতে ব্যবহৃত সব থেকে কমন এই রুলটি আসলেই সুন্দর একটি রুল। এটি ফলো করে আপনি সহজেই ছবিতে আনতে পারবেন নতুনত্ব এবং সৌন্দর্য। রুল অফ থার্ড বা শুধু থার্ডস এর নিয়মটি হল, আপনাকে ক্যামেরার যেখানে ছবি দেখেন সেটিকে মনে মনে উপরে-নিচে এবং ডানে-বামে উভয় দিকে সমান তিনটি ভাগ করে নিতে হবে। ঠিক ছবির মত। এটি সব সময় আপনার মনে মনেই করতে হবে। তবে বেশ কিছু ক্যামেরা এখন এই দাগ দেখায়, সেটাও ব্যবহার করতে পারেন। এটি হিসাব করলে আপনার ভিউটি মোট ৯টি ভাগে বিভক্ত হবে। এখন আপনি যেই জিনিষ বা যার ছবি তুলতে চান অর্থাৎ আপনার ছবির সাবজেক্ট কে এই দাগগুলির যে কোন একটি ক্রস পয়েন্ট রাখুন। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন যে একটি গাছ এখানে মূল সাবজেক্ট, সেটিকে ৪টি ক্রসের একটিতে রাখা হয়েছে। এমন ভাবে কারও মুখ বা অন্য কোন বস্তু রাখতে পারেন। এতে করে স্বাভাবিকের থেকে ছবি সুন্দর লাগে। কারণ যখন থার্ডস ব্যবহার করে আপনি ছবি তুলবেন, তখন যে ছবিটি দেখবে তার চোখ পুরো ফ্রেমটিতে আগ্রহী হবে, আর প্রথমেতো ফোসাক/সাবজেক্ট কে দেখবেই। এতে করে দর্শক আপনার পুরো ছবিটিকে গুরুত্ব দিবে, এবং স্বাভাবিকের থেকে সুন্দরও দেখাবে।
২. চেষ্টা করুন হাত না কাঁপিয়ে ছবি তুলতেঃ
ছবি তোলার সময় যদি ক্যামেরা কেঁপে যায়, তাহলে ছবিটি ব্লার হয়ে যেতে পারে। যদিও দিনের বেলায় প্রচুর আলোতে তুললে এটি নাও হতে পারে, তবে রাতের বেলায় এক চুল নড়া মানেও ছবির দফা রফা হয়ে যাওয়া! অনেক সময় দেখা যায় যে ক্যামেরার ছবি প্রিভিউতে আপনি হয়ত সেটি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু কম্পিউটারে নিলে সেটি বুঝতে পারবেন। এটার জন্য সবার প্রথমেই আপনাকে শিখতে হবে কি করে আপনার ক্যামেরাকে ঠিক করে ধারতে হয়। ঠিক এই লাইনটা লেখার সাথে সাথে মাথায় আসল যে আগামি লেখায় আমি ক্যামেরা ধরার পদ্ধতি নিয়েই লিখব, তবে এখানে সংক্ষেপে কিছু কথা বলে যাচ্ছি। ক্যামেরা ঠিক মত ধরতে না পারলে ছবি তোলার সময় ক্যামেরা নড়ে যেতে পারে। ক্যামেরা যেটিই হোক না কেন, ভাব মেরে এক হাতে তোলার কোন মানে নেই। এমনকি সেটা যদি মোবাইল ক্যামেরাও হয়। এক হাত আপনার ক্যামেরার বডি ধরার জন্য ব্যবহার করুন, অন্য হাত দিয়ে লেন্স ধরুন। যদি লেন্স ওয়ালা ক্যামেরা না হয়, তাহলে অন্য হাতটি ক্যামেরার নিচে রাখুন। এবং ক্যামেরা আপনার দেহের যতটুকু কাছে ধরে সম্ভব ছবিতুলুন, তাহলে কম কাঁপবে। এছাড়া যদি রাত্রের ছবি তুলেন, তাহলে অবশ্যই অবশ্যই ট্রাইপড বা অন্য কোন শক্ত স্থানে রেখে তুলুন। ট্রাইপড বা শক্ত কোন স্থানে রাখা না গেলে একটা কাজ করতে পারেন। নিশ্বাস নিন, এবার নিশ্বাস বন্ধ করুন, দম ছাড়বেন না, ছবি তুলুন, তারপর দম ছাড়ুন। দম উঠা নামা করার সময় আমাদের দেহ একটু বেশিই কাঁপে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে অন্তত সেটা একটু হলেও কম পাবেন। নিচের ছবিটি দেখতে পারেন।
৩. সূর্যের ১৬ রুলঃ
রোদ্রের মধ্যে ছবি তোলার জন্য এই রুলটি যথেষ্ট কার্যকারী হলেও আমরা অনেকেই এটির বিষয়ে কিছুই জানিনা। এটির নিয়ম হল, সূর্যের আলো যখন প্রখর তখন আপনার ক্যামেরার এ্যাপাচার ঠিক করুন f/16 এবং ক্যামেরার সাটার স্পিড কম পক্ষে 1/100 রাখুন। এবার সাটার স্পিড যত হবে, ISO ও ঠিক সেই পরিমান রাখুন। মানে যদি ISO-100 হয় তাহলে , সাটার স্পিড 1/100 ; যদি ISO-200 হয়, সাটার স্পিড 1/200 বা 1/250; এমন ভাবে রাখুন। এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে হলে আপনার ক্যামেরায় ম্যানুয়াল মুড থাকতে হবে। আর এই পদ্ধতিটি সব থেকে ভাল কাজে দেয় যখন আপনার ক্যামেরায় প্রিভিউ দেখার ব্যবস্থা নেই অথবা আপনার কাছে কোন লাইট মিটার নেই।
৪. পোলারাইজ ফিল্টারের ব্যবহারঃ
আপনি যদি ক্যামেরা কেনার পর কিছু কিনতে চান, তাহলে গুরুজনদের সাজেশন হল পোলারাইজার ফিল্টার কেন। কারন এটি মেটাল, কাঁচ, পানি ইত্যাদির রিফ্লেকশন থেকে ছবিকে বাঁচিয়ে সুন্দর ছবি দেয়। এতে করে আকাশের এবং প্রাকৃতিক রংগুলিও সুন্দর হয়। তাছাড়া এটি আপনার দামী লেন্সকেও ধুলাবালি থেকে বাঁচায়। নিচের ছবিতে পোলারাইজড ফিল্টারের ব্যবহারের উদাহরণ পাবেন।
৫. ডেপ্থ সেন্স ব্যবহার করুনঃ
এই ডেপ্থের সরাসরি বাংলা কোন ওয়ার্ড মনে করতে পারছি না, তাই পরবর্তি অংশ পড়েই বুঝে নিতে হবে। ধরেন আপনি কোন একটি পাহাড়ের ছবি তুলতে চাচ্ছেন। এখন আপনি কম এপাচার দিয়ে দারুন একটা ছবি তুললেন, যেখানে সামনে থাকা বেক্তি ছাড়া সব কিছুই ব্লার, ঠিক ৭ নং ছবির মত করে ! কি হল ঘটনা? কেউ কি বুঝবে যে ছবিটা পাহাড়ে তোলা! এটা বোঝানোর জন্য আপনাকে যা করতে হবে, তাহল মাঝা মাঝি একটা এপাচার (যেমন ধরেন f/16) সিলেক্ট করতে হবে। যাতে করে আপনার সাবজেক্ট এবং ব্যাকগ্রাউন্ড, দুটিই সুন্দর ভাবে বোঝা যায়। আর শুধু পাহাড়ের ছবি না তুলে যদি সামনে কোন একটি সাবজেক্ট নিতে পারেন (এমন না যে সাবজেক্ট কে ক্যামেরার দিকেই মুখ করে থাকতে হবে, ছবির উদাহরণ দেখুন), এতে করে আপনার কাছের বস্তু এবং দুরের বস্তুর দুরত্বটা মানুষ বুঝতে পারবে। আর এই ক্ষেত্রে সম্ভব হলে ট্রাইপড ব্যবহার করুন। কারণ ছোটো এপাচার (f/4 থেকে f/16 ছোট এ্যাপাচার, ক্যালকুলেশন অন্য লেখায় দেওয়া হবে) মানেই সাটার স্পিড একটু কম হতে হয়, হাত কেঁপে যেতে পারে।
৬. সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করুনঃ
ছবি তোলার সময় সব সময়ই সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করুন। কারণ, ধরেন ছবির সাবজেক্ট থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক আকর্ষণীয়, তাহলে মানুষ আর সাবজেক্ট কে দেখবে না, দেখবে ব্যাকগ্রাউন্ড কে। আবার ধরেন ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক অনেক হিবিজিবিতে ভরা, সেই ক্ষেত্রে আপনি যদি ব্যাকগ্রাউন্ডকে ব্লার না করেন, তাহলে মানুষ ছবির মধ্যে ঘুরপাক খাবে, কিন্তু কিছুই বুঝবে না। সম্ভব হলে সব সময় প্লেইন একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করুন। এক কথায় ন্যাচারাল কালার, বা সিম্পিল প্যাটার্ন ব্যবহার করাই উত্তম।
৭. ঘরের মধ্যের ফটোগ্রাফিতে ফ্লাশ এভয়েড করুনঃ
না! চমকে যাবার মত কিছু বলিনি। ফ্লাশ দেওয়া ছবি স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ দেখায়। আর ঘরের মধ্যে হলেতো আরও দফা রফা। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা কাজ করতে পারেন। প্রথমত ক্যামেরার ISO বাড়িয়ে 800 বা 1600 করে নিতে পারেন, এতে করে সাটার স্পিড কম রেখেই ছবিতে পাবেন বড় একটি পার্থক্য পাবেন, পাবেন বেশি আলো! আর একটি কাজ করতে পারেন, তাহল যত বড় এপাচার ব্যবহার করা যায় (f/4 বা তারও বড় f/3.5, f/2.8, f/1.4 ব্যবহার করতে পারেন), এতেও আলো বেশি পাবেন। আর যদি সম্ভব হয়, অবশ্যই ট্রাইপড ব্যবহার করেন। তাহলে স্বাভাবিক আলোতেই সুন্দর ছবি পাবেন। আর হ্যাঁ ছবি তোলার সময় মডেল যেন না নড়ে! নিচের ছবিটি দেখুন।
৮. সঠিক ISO নির্ধারণ করুনঃ
ছবি তোলার সময় সঠিক ISO নির্বাচন করাটা একটা গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। ISO নির্ধারণ করে যে আপনা ক্যামেরা ঠিক কতটুকু আলোর প্রতি সংবেদনশীল হবে। বিষয়টা এমন যে সব সেটিংস একই রেখে ISO-100 তে তোলা ছবির থেকে ISO-400 তে তোলা ছবি বেশি আলো পাবে। এটি আপনাকে সাহায্য করবে সঠিক সময়ে সঠিক আলোর সংবেদনশীলতা কমিয়ে বাড়িয়ে ছবিকে সুন্দর করতে। যখন আমরা অন্ধকারের মধ্যে তুলি, তখন বেশি ISO (eg. ISO-400 – 3200) আপনাকে অনেক আলো দিবে। আবার যখন প্রচুর আলোতে ছবি নিবেন, তখন কম ISO (eg. ISO-100) সিলেক্ট করা উচিত। তবে মাথায় রাখতে হবে যে রাতের বা অন্ধকারের ছবিতে অতিরিক্ত বেশি ISO আপনার ছবিতে অনাকাঙ্খিত নয়েজ এনে দিতে পারে।
৯. গতি বুঝাতে প্যানিং করুনঃ
প্যানিং হচ্ছে গতিশীল বস্তুর ছবি তোলার টেকনিক। এটিতে আপনাকে মূল বস্তুর গতির সমগতিতে আপনার ক্যামেরা মুভ করতে হবে, এবং ছবি তুলতে হবে। নিচের ছবিটিতে দেখুন। এমন ছবি তোলার জন্য স্বাভাবিক ভাবে সাটার স্পিড 1/60 বা আপনার প্রয়োজন মত রাখতে হবে। কোন বস্তুর ছবি তোলার জন্য প্রথমে আপনার সাটার বাটনে হালকা চাপ দিয়ে এটিকে ফোকাস করুন, এবং এটির সাথে আপনার ক্যামেরাও মুভ করতে থাকুন। এবং সময় মত ছবি তুলুন। সম্ভব হলে ট্রাইপড বা মনোপড ব্যবহার করুন। আর হ্যাঁ আগেই বলি, এটিতে বেশ প্রাকটিস লাগে। শিশুপার্কের দোলনা, মটরসাইকেল, সাইকেল ইত্যাদির ছবি তুলতে পারেন।
১০. সাটার স্পিড নিয়ে খেলা করুনঃ
সাটার স্পিড কমিয়ে বাড়িয়ে বেশ সুন্দর ছবি পেতে পারেন। উদাহরণ দেখতে আগেই নিচের ছবি দুইটি দেখেন। প্রথমটার ক্ষেত্রে সাটার স্পিড বেশি, তাই কয়েকটি দাগ এসেছে, কিন্তু পরের ছবিটিতে একটু কম সাটার স্পিড হওয়ার কারণে সুন্দর একটি চাকতি পাওয়া গেছে। এটির জন্য সাটার স্পিড কয়েক সেকেন্ড করতে পারেন। অনেক সময় আমরা ছবি দেখি যে রাস্তার উপরে দিয়ে লাল এবং সাদা দুইটা করে দাগ চলে গেছে এমন ছবি। সেটিও এই টেকনিকে তোলা হয়। উচুঁ কোথাও দাঁড়ান, কম সাটার স্পিডে ছবি তুলেন, দেখেন মজা। ট্রাইপড বা শক্ত কোন সারফেস মাষ্ট। হাতে রেখে তুললে একটু হলেও কাপঁতে পারে।
লেখাটি পূর্বে TechBlog.com.bd তে প্রকাশিত হয়েছে।
এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি যেইসব ওয়েব সাইট ও রিসোর্সের সাহায্য নিয়েছি, তাদের ধন্যবাদ। তবে সব লেখা কোন না কোন ইংরেজী লেখা থেকে নিয়ে আমার নিজেরই বাংলায় করা।
Thanks A Lot for clearing some confusion …