হতে চাই আলোকচিত্রী – সাহাদাত পারভেজ

আলোকচিত্রীর ভাবনাগুলো চিত্র আকারে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন, তা শুধু শাটারস্পিড, অ্যাপারচার আর ফোকাস পর্যন্ত জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কেউ ছবি তোলেন হৃদয় দিয়ে, কেউ মাথা খাটিয়ে। যেভাবেই তোলেন, অনুশীলনের কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। ছবি তোলা শিখতে চাইলে আগ্রহটাই বড় বিষয়। সঙ্গে দরকার ফটোগ্রাফির প্রতি মায়া, দরদ, সর্বোপরি ভালোবাসা। ফটোগ্রাফি শুধু শখে ছবি তোলা নয়, এটি সচেতনতার এক বিশাল মাধ্যম। জগতের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে কত না ছবি! সব কী তুলে শেষ করা সম্ভব? ছবি কি রাস্তায় থাকে? না। থাকে মাথায়, হৃদয়ে। কেবল সময়মতো তুলে নিতে হয়।

ছবি জোর করে বানানো যায় না। তোলা যায় না। ছবি হয়ে যায়। এর জন্য ধ্যানের প্রয়োজন হয়। যার মাথায় সারাক্ষণ ছবি তোলার নেশা, তার ক্যামেরার জালে ছবি ধরা না দিয়ে পারে? ছবি তোলার জন্য দরকার আলোকচিত্রীর সঙ্গে বিষয়বস্তুর ঘনিষ্ঠতা। কোথাও ছবি তুলতে গেলেন। দেখবেন শুরুর দিকে ছবি হচ্ছে না। সময় নিন। ভালো করে সব কিছু দেখুন। বিষয়বস্তুকে বোঝার চেষ্টা করুন। দেখবেন ছবি আপনা-আপনি ধরা দিচ্ছে। এর মানে হলো, বিষয়বস্তুর সঙ্গে আলোকচিত্রীর সম্পর্ক তৈরি না হলে ছবি হয় না। ছবি শুধুমাত্র চারকোনা ফ্রেমে বন্দি কোনো দৃশ্য নয়। ছবি হচ্ছে আলোকচিত্রীর ভাবনার রিফ্লেকশন্রৃ। ছবি দেখেই শিল্পীর মনের ভেতরটা সহজে পড়ে ফেলা যায়।

অনেকে মনে করেন, দামি ক্যামেরা থাকলেই ভালো ছবি তোলা যায়। ধারণাটি ভুল। ক্যামেরা একটি যন্ত্র মাত্র। এটি আসলে কিছুই ভাবতে পারে না। ভাবেন তিনি, ক্যামেরার পেছনে যিনি থাকেন। তিনিই জানেন কী তুলবেন আর কী তুলবেন না। আমি বলি, ৮০ পার্সেন্ট সেনস, ১০ পার্সেন্ট ক্যামেরা আর ১০ পার্সেন্ট লেন্স। তবে ভালো ক্যামেরার যে প্রয়োজন নেই একেবারেই, সে কথা বলছি না। দামি ক্যামেরা আর ভালো লেন্স শার্প ছবি দিতে পারে। ভালো রেজ্যুলেশন দিতে পারে। ফাস্ট ক্যামেরা দ্রুত ছবি তুলতে পারে। কম আলোয় মানসম্মত ছবি দিতে পারে। সারা পৃথিবীর প্রফেশনাল ফটোগ্রাফাররা তাই ডি এসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করে থাকেন।

যারা সবে ফটোগ্রাফিতে এসেছেন, তাদের একটি বিষয়বস্তুর ছয়টি অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা উচিত। ফটোগ্রাফিতে এটাকে সিক্স অ্যাঙ্গেল অব ভিউ বলে। বিষয়বস্তুর সামনে, পেছনে, দুই পাশে, ওপর আর নিচ থেকে ছবি তুললে সহজেই বোঝা যায় কোন অ্যাঙ্গেলের ছবিটি সঠিক অথবা কোন অ্যাঙ্গেলটি আপনি চেয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে তুললে ছবির নানা রকম পারসপেকটিভ তৈরি হয়। ছবি তোলার সময় কম্পোজিশন ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হয়। ছবি মানে সবকিছু দেখানো না। ছবি হচ্ছে খণ্ডিত অংশ। যা পুরো বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। আমার কাছে কম্পোজিশন মানে হলো লোভ সংবরণ করা। বিষয়বস্তুর কতটুকু বাদ দেব। বাদ দিয়ে যতটুকু থাকবে, ততটুকুই হচ্ছে ছবি।

আলো ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আলো নিয়েই আলোকচিত্রীদের কাজ-কারবার। মূলত দুটো উৎস থেকে আমরা আলো পাই। আলোর প্রধান উৎস সূর্য আর চন্দ্র। এছাড়া নানা কৃত্তিম উপায়ে আলো পেয়ে থাকি। সান লাইটকে ফটোগ্রাফির ভাষায় বলা হয় ডে-লাইট। আর ডে-লাইটকে ভিত্তি করেই বানানো হয়েছে ফ্যাশ। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা হয় যখন আলো থাকে না বা কম থাকে। সাধারণত সূর্যকে বিপরীতে রেখে ছবি তুলতে হয়। সূর্য বিষয়বস্তুর পেছনে থাকলে ছবি সিল্যুট হয়ে যায়। বিষয়বস্তু থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডে আলো বেশি থাকেলে ছবি কালো হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ছবি তুলতে হবে আলোর উল্টোদিকে। অবশ্য ইচ্ছে করে সিল্যুট তুলতে চাইলে অন্য কথা।

ছবি তোলার জন্য বিষয়বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় সাবজেক্টের চেয়েও ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যাকগ্রাউন্ড ছবির চেহারাকেই পাল্টে দেয়। ছবিতে ছায়া ও রং অন্য রকম ব্যঞ্জনা তৈরি করে। একটা কথা বলে রাখা দরকার, আলো ছাড়া কিন্তু ছবি তোলা একেবারেই অসম্ভব। তাই ছবি তুলতে চাইলে আলোকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আলোর মন-মর্জি। সাধারণত নবীন আলোকচিত্রীরা সকাল ও বিকেলের আলোয় ছবি তুলে থাকেন। এর একটা কারণও আছে। সকালের আলো কোমল। দুপুর হতে হতে সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে। বিকেলে আবার সূর্যের তেজ কমে। ফলে নরম আলোয় ছবি তুলতে সুবিধা। মেঘাচ্ছন্ন দিনে সূর্য মেঘে ঢাকা থাকে বলে বিষয়বস্তুর ওপর প্রায় একই রকম আলো প্রতিফলিত হয়। ফলে লাইট নিয়ে তেমন ভাবতে হয় না।

প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের মনের মতো। সকালে মানুষের মন থাকে বেশ ফুরফুরে। আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজাজও কড়া হতে থাকে। দুপুরের আলোতে তাই অনেকেই ছবি তুলতে চান না। কিন্তু অনেক সময় তা অনিবার্য হয়ে ওঠে। দুপুরে আলোয় প্রকৃতি, অরণ্য, নদী, পাহাড়, নগর কিংবা ল্যান্ডস্কেপের ছবি তোলা তেমন কোনো সমস্যা নয়। তবে মানুষের ছবি তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। সে ক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলা উচিত। অনেকের ধারণা, প্রখর রৌদ্রে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবি তুললে ছবি নষ্ট হয়ে যায়। রোদের আলোর সঙ্গে ফ্যাশের আলোর সমন্বয় করে ছবি তোলাকে ফিলফ্যাশ বলে। দুপুরে আলোয় ছবি তুললে মানুষের মুখের ভাঁজে, চোখের নিচে কিংবা শরীরের বিভিন্ন কার্ভ লাইনে ছায়া পড়ে। দেখতে খারাপ লাগে। ফিলফ্ল্যাশে ছবি তুললে তা কেটে যায়।

ডিসাইসিভ মোমেন্ট ফটোগ্রাফিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিসাইসিভ মোমেন্ট মানে সময়মতো প্রতীক্ষিত ছবিটা ক্যামেরায় ধারণ করতে পারা। এই প্রত্যাশিত মুহূত্ব ঘটনার যে কোন সময় ধরা দিতে পারে। এই মোমেন্ট না বুঝলে চোখের সামনে আসল জিনিস মিস হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হাহাকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মনের ভেতর কিছু একটা লালন করলে তা বারবার চোখের সামনে এসে ধরা দেয়। যার মনের চোখ যত তীক্ষ্ণ তিনি তত বেশি ডিসাইসিভ মোমেন্ট দেখতে পান। ফটোগ্রাফিতে এলিমেন্ট বুঝাটাও জরুরী। একটি ছবিতে প্রধানত দুটি এলিমেন্ট থাকে। একটি স্টোরি আর অন্যটি ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট। এই এলিমেন্টগুলোর কারনেই আমরা ছবির অন্তর্নিহিত বক্তব্য খুঁজে পাই।

যন্ত্র হলেও ক্যামেরার একটা অসাধারণ মতা আছে। মানুষকে সহজে ডমিনেট করতে পারে। মানুষের মনোজগতে দ্রুত প্রভাব ফেলতে পারে। আলোকচিত্রীর ক্ষমতাও অনেক। তার লেন্সে যতটুকু ইমেজ ধরা পড়ে ততটুকুই আমরা দেখতে পাই। এর বেশি দেখার সুযোগ নেই আমাদের। আলোকচিত্রীরা সব সময় ছবির মানুষদের নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে চান। অথচ ছবির মানুষেরা ক্যামেরায় কীভাবে উপস্থাপিত হতে চায়, সেটা অনেক সময় ভেবে দেখা হয় না। তার পরও বলবো একজন আলোকচিত্রীর সঙ্গে অন্যদের যে মৌলিক পার্থক্য, সেটি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভাজন ও দূরত্ব কমায়। আলোকচিত্রীর মূল কাজ হচ্ছে মানুষকে পড়তে পারা, বুঝতে পারা এবং তার ভাবনাগুলো মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া।

ফটোগ্রাফির জন্য দরকার ব্যতিক্রমী চোখ। যা সবাই দেখতে পায়, তা আলোকচিত্রীর দেখার বিষয় হতে পারে না। একটা দৃশ্য তারা ভিন্নভাবে দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। জাত শিল্পীরা নাকি আগেবাগেই ছবির গন্ধ পেয়ে থাকেন। আলোকচিত্রীদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ছবি তুলতে হয়। অবশ্য ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতে ভাবনাচিন্তার অনেক সময় পাওয়া যায়। গবেষণা ও পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়া যায়। আলোকচিত্রী ভাববেন বেশি, ছবি তুলবেন কম সময়। ডকুমেন্টারি প্রকল্পটা যদি এক মাসের হয়, তাহলে তিন সপ্তাহ ভেবেচিন্তে এক সপ্তাহ ছবি তোলা উচিত। সংবাদচিত্রও অধিকাংশ সময় ডকুমেন্টারি ফটো হিসেবে বিবেচিত হয়। ফটোসাংবাদিকতা ও ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি বিষয়বস্তুর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যায় আলোকচিত্রীকে।

প্রতিষ্ঠান আসলে কাউকে শিা দিতে পারে না, যদি না কেউ শিখতে চায়। ফটোগ্রাফি শিখতে চাইলে শেখার প্রবল ইচ্ছা থাকতে হবে। জানার চেষ্টা থাকতে হবে। কৌতুহলী হতে হবে। অনেকে বলেন, ফটোগ্রাফি শিখতে চাইলে পাগল হতে হয়। আত্মার ভেতরে একটা পাগল মন থাকতে হয়। ওই পাগল স্বভাবটাই শিল্পী, মানুষটা না। প্রতিষ্ঠান তো কাউকে শিল্পী বানাতে পারে না। সার্টিফিকেট দিতে পারে। শেখার জন্য গাইডলাইন দিতে পারে। নানাভাবে শেখা যায় ফটোগ্রাফি। বই পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে, অভিজ্ঞ কোনো আলোকচিত্রীর সঙ্গে থেকে কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে। একসময় ওস্তাদের হাত ধরে ফটোগ্রাফিতে আসার রেওয়াজ ছিল। এখন ফটোগ্রাফিক স্কুলে গিয়েই শিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন অনেকে।

আমাদের দেশে এখন বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাঠশালা, বেগার্ট, প্রিজম, কাউন্টার ফটো উল্লেখযোগ্য। পাঠশালা থেকে ফটোগ্রাফিতে গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত করা যায়। কাউন্টার ফটোতে করা যায় এক বছরের ডিপ্লোমা। প্রিজম থেকে নেওয়া যায় ছয় মাসের ডিপ্লোমা। আর সবচেয়ে প্রাচীন আলোকচিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেগার্ট থেকেও নেওয়া যায় প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া ফটোফি, বিপিএস, ফ্রাস্ট লাইট, অলিয়ঁস ফ্রঁসেস, ডিইউপিএস, চঞ্চল মাহমুদ স্কুল অব ফটোগ্রাফি, ঢাকা ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট ও ফটো লাউঞ্জের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসিক, অ্যাডভান্স বেসিক ও বিভিন্ন বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। দেশের বাইরেও আছে শেখার অবারিত সুযোগ।

ফটোগ্রাফি একটি এক্সপেনসিভ ও স্মার্ট প্রফেশন। মানুষকে এ পেশা সহজে আকৃষ্ট করে, বিশেষ করে তরুণদের। আমাদের দেশে তরুণদের মধ্যে এখন ফটোগ্রাফিতে আসার একটা সুবর্ণ সময় চলছে। অনেকের হাতেই এখন ক্যামেরা। যার ক্যামেরা নেই, তার হাতেও মোবাইল ক্যামেরা। ছবি তোলেন কেউ শখে আবার কেউ পেশাগত কারণে। তবে ছবির গুরুত্ব আছে সর্বত্রই। পৃথিবীর এমন কোনো ত্রে নেই, যেখানে ছবির ব্যবহার নেই। এই যে এত বিলবোর্ড, যার জন্য নগরের আকাশ দেখা যায় না। এই বিলবোর্ডগুলোতে ছবির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এগুলো কেউ না কেউ তোলেন। এর মানে, ছবির একটি বিশাল বাজার রয়েছে। এখন ভালো ছবির পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা থাকলে সর্বত্রই নিজের জায়গা করে নেওয়া যায়। শুধু নিজের দেশ নয়, বিশ্বই আলোকচিত্রীর কর্মত্রে। ফটোগ্রাফির একটি বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে ফটোসাংবাদিকতা। সংবাদপত্র ছাড়াও সংবাদ এজেন্সি, ফটো এজেন্সি, অনলাইন পত্রিকা, পিকচার লাইব্রেরিতে সংবাদচিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ফ্যাশন-মডেল ফটোগ্রাফি, আর্ট ফটোগ্রাফি, স্টিল লাইফ, প্রডাক্ট অ্যান্ড ফুড ফটোগ্রাফি, ওয়াইল্ড লাইফ, বার্ডস, ন্যাচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি, এরিয়াল ফটোগ্রাফি, আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফি, স্পোর্টস ফটোগ্রাফি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আজকাল ওয়েডিং ফটোগ্রাফিরও বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, অ্যাড এজেন্সী এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন ও স্বল্প মেয়াদী কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

সৃজনশীলতার পাশাপাশি ফটোগ্রাফি একটি কায়িক শ্রমের পেশা। স্রোতের বিপরীতে পথ চলতে গেলে কত কিছু যে স্বীকার করে নিতে হয়! পৃথিবীতে যারাই সফল আলোকচিত্রী, তাঁদের প্রায় সবারই পরিশ্রমী জীবন। ঘরে বসে সবকিছুর ছবি তোলা যায় না। ছবি তোলার জন্য আলোকচিত্রীকে সময়ে-অসময়ে দুর্যোগপূর্ণ কিংবা দুর্গম স্থানেও যেতে হতে পারে। এর জন্য শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস দরকার। ক্যামেরা, লেন্স আর যন্ত্রপাতির একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজন আছে। আলোকচিত্রীকে প্রায় প্রতিদিন এই ওজন বহন করতে হয়। ক্যামেরার ভার আলোকচিত্রীর কাছে মাতৃত্বের সুখানুভূতির মতো। ছবি তোলাকে আত্মার খোরাক হিসেবে নিলেই এমনটি সম্ভব, না হলে নয়।

এখন অনেকেই ভালো ছবি তোলেন। টিকে থাকবেন তারাই, যারা লেগে থাকবেন। আলোকচিত্রীর কাজ শুধু ভালো ছবি তোলা নয়। তারা সংস্কারকের মতো সমাজের, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। তাই তাদের দায়বদ্ধতাও বেশি। একজন দায়িত্বশীল আলোকচিত্রী প্রথমত অনুসন্ধিৎসু ও সময় সচেতন। নৈতিকতা বোধ, কমিটমেন্ট ও ডেডলাইন নিয়ে তাদের ভাবতে হয়। তবে সবারই নিজস্ব একটি স্টাইল থাকা উচিত। কাজের ক্ষেত্রে স্বকীয়তা কিংবা নিজের মতো ঘরানা তৈরি করতে পারলে তাকে নিঃসন্দেহে সার্থক ফটোগ্রাফার বলা যায়। বিশ্ববরেণ্য আলোকচিত্রী স্টিভ ম্যাককারির চিত্রকর্মে আমরা তাঁর সিগনেচার খুঁজে পাই। তাঁর ছবির মূল বিষয়বস্তু মানুষ। তাঁর তোলা ছবি দেখে জীবনকে উপলব্ধি করা যায়।

একটা লক্ষের বোধ নিয়ে যারা ছবি তোলন, তারা প্রায় সবাই আলোকচিত্রী। তবে কেউ প্রফেশনাল, কেউ অ্যামেচার। প্রফেশনাল মানে যার উপর ভরসা করা যায়। দায়িত্ব দিয়ে নির্বিঘ্নে থাকা যায়। তিনি পেশাজীবী হতে পারেন আবার ফ্রিল্যান্সও হতে পারেন। পেশাজীবীরা কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত হিসেবে চাকরি করেন। ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফাররা স্থায়ীভাবে কোথাও কাজ না করলেও তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় ছবি তুলে। আর অ্যামেচার ফটোগ্রাফাররা ছবি তোলেন শখের বসে। পৃথিবীর বেশির ভাগ আলোকচিত্রীই সিঙ্গেল ছবি তুলে থাকেন। আবার অনেকে ছবি দিয়ে গল্প বলেন। ফটো স্টোরি, ফটো ফিচার, ফটো অ্যাসে কিংবা ফটো সিরিজ নির্মিত হয় নির্বাচিত কয়েকটি ছবির সমন্বয়ে।

ফটোগ্রাফি করার জন্য দরকার সংবেদনশীলতা। জীবনোপলব্ধির মধ্য দিয়ে যে চিত্র নির্মিত হয়, একেই তো আমরা ছবি বলি। নিজে সংবেদনশীল না হলে আমরা কেমন করে মানুষের সংবেদনশীলতাকে ক্যামেরায় ধারণ করব? জীবনবোধের মধ্য দিয়ে উঠে আসে যে ছবি, সেই সব ছবির দিকে আমরা বারবার ঘুরে তাকাই। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি কিংবা নড়েচড়ে উঠি। ছবিগুলো আমাদের প্রাত্যহিক আলোচনার অংশ হয়ে ওঠে। আমাদের মস্তিষ্কের মেমোরিতে অনেক দিন পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। প্রতি মাসে ফ্লিকারে গড়ে ৩.৫৭ বিলিয়ন ছবি আপলোড হয়। আর ফেসবুকে প্রতিদিন আপলোড হয় প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ছবি। এই হিসেব থেকে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি, প্রতিদিন সারা বিশ্বে কতসংখ্যক ইমেজ নির্মিত হচ্ছে।

ছবি একটি সার্বজনিন ভাষা। সহজে পড়া যায়। যার অর জ্ঞান নেই তিনিও ছবি পড়তে পারেন। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। একটি লেখা অনুবাদিত হয়ে অন্য ভাষার মানুষের কাছে গেলে প্রকাশ ভঙ্গির কারণে তার ইমোশন কমে। কিন্তু একটি ছবি ১০০ পার্সেন্ট সাবলিলতা নিয়ে মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়। কোন অবস্থাতেই এক পার্সেন্ট ইমোশনও কমে না। এটাই হচ্ছে ছবির বড় শক্তি। মানুষের রক্ত লাল আর সমস্থ পৃথিবীর ছবির ভাষা এক-অন্তত এই দুটি বিষয় আমার কাছে চরম সত্য। সার্বজনিন ভাষা বলেই পৃথিবীর যে কোনো দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা আর আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ভঙ্গি ছবিতে একই রকম।

মানুষের জীবন একটাই। শুধু এক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কী আর চলে? জীবনকে নানাভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে জানতে হয়। অন্য জীবনের স্বাদ নিতে হয়। একেই বলে জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগ। জীবনকে বুঝতে আলোকচিত্রীকে মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে হবে। চোখ হচ্ছে মানুষের অতল অন্তরের জানালা। চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে মনের অনুভূতি। চোখে-মুখে প্রকাশ পায় এক্সপ্রেশন। এক্সপ্রেশন না থাকলে ছবি প্রাণহীন। ছবিতে গতি, শক্তি, প্রাণ কিংবা উজ্জ্বলতা থাকলে তা আরও বেশি প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। ভালো ছবি সেটিকেই বলব যেটি প্রথমত টেকনিক্যালি সাউন্ড। সংগত ব্যাখা থাকলে একটি সাধারণ ছবিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আলোকচিত্রীদের হতে হয় পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। আমরা যারা বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী, তারা পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের কীভাবে দেখব-উপজাতি নাকি আদিবাসী হিসেবে? যাত্রা মঞ্চের ঝলমলে আলোয় বিদ্যুৎ চমকানোর মতো শরীর নাচায় যে নটী কিংবা নগরের রাস্তায় রাতের অন্ধকারে খদ্দের জোগায় যে বারবনিতা, তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতিকে কেমন করে তুলে ধরবে আলোকচিত্রীর লেন্স? এগুলোই আসলে ভাববার বিষয়। আলোকচিত্রীরা সব সময় এসব প্রান্তবর্গীয় মানুষের জীবনযাপনকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেন। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য এই ভাবনাগুলো ছবির মাধ্যমে সমাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারাটাই হচ্ছে সার্থকতা।

যখন শিশুদের ছবি তুলি, তখন দাঁড়িয়ে না তুলে বসে যাওয়া উচিত। কারণ, শিশু আর আমাদের উচ্চতা এক নয়। আমরা শিশুদের ভালোবাসি। কারণ, আমরা শিশু ছিলাম কিংবা আমাদের সবার ঘরেই শিশু আছে। তাই শিশুদের ছবি তোলার সময় খুবই যত্ন নিয়ে তোলা উচিত। প্রতিবন্ধী কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুর ছবি তোলার সময় তাদের চেহারায় যেন ডিসটরসন (আকৃতিগত বিকৃতি) না হয়। যখন হিজড়াদের ছবি তুলব, তখন কী করব! এদের ছবি বার্ড আই অ্যাঙ্গেলে না তুলে স্কাই আই অ্যাঙ্গেলে তোলা উচিত। কারণ, এদের সবাই দেখে নিচু দৃষ্টিতে। সমাজে এরা উপেক্ষিত বলেই এই বিভাজন। এখানেই আলোকচিত্রীর সঙ্গে অন্যের ভিন্নতা।

দায়িত্বশীল আলোকচিত্রী হতে চাইলে কিছু এথিকস অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ছবি তোলার কারণে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়। জীবন যেন বিপন্ন না হয়। মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্যই ফটোগ্রাফি। কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের সামাজিক সম্মান ক্ষুন্ন হয় এমন ছবি তোলা উচিত নয়। নির্যাতিত নারী কিংবা দিগম্বর শিশুর ছবি তোলার সময় আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। বস্ত্রহীন আদিবাসী নারীদের ছবি তুলতে গেলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে-কেন এই ছবি তুলছি। ছবি তোলাই আলোকচিত্রীর একমাত্র দায়িত্ব না। দুর্ঘটনা কিংবা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আলোকচিত্রীর কোনো প্রচেষ্টা যদি কোনো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তাহলে ক্যামেরা রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

আজকের ছবি আগামীর দলিল। যত ভালো আলোকচিত্রীই হন না কেন, সময়মতো ছবি খুঁজে না পাওয়া গেলে তা অর্থহীন। তাই আগে ছবি সংরণ করতে জানতে হবে। প্রতিদিনের ছবি তারিখ অনুযায়ি সাজিয়ে এক মাসের কাজ সিডি, ডিভিডি অথবা এক্সটা হার্ডড্রাইভে রাখা যেতে পারে। ডিজিটাল ক্যামেরায় র ফরমেটে ছবি তোলা ভালো। এতে প্রয়োজনে কিংবা পরবর্তী সময়ে ছবিতে কাজ করতে সুবিধা। অন্ধের মতো একই বিষয়ের শত শত ছবি না তুলে বুঝে শুনে তোলা উচিত। ছবি তোলা যতটা না কঠিন তার চেয়ে বেশি কঠিন ছবি বাছাই করা। নিজের তোলা ছবি সন্তানের মতো। ফেলতে ইচ্ছে করে না। মায়া লাগে। ফটোগ্রাফারই হচ্ছে ছবির প্রথম ফটো এডিটর। আর ফটো এডিটরের কাজ হচ্ছে সিলেকটিভ হওয়া।

আলোকচিত্রীরা কেবল ইতিহাসের সাক্ষীই না, সত্যিকারের ইতিহাস নির্মাতাও। রাজ্যের কারনে নয়, রাজার কারনেই নির্মিত হয়েছে ইতিহাস। আমাদের প্রথাগত ইতিহাসে তাই রাজ্যের চেয়ে রাজা গুরুত্ব পেয়েছেন অনেক বেশি। আসলে ইতিহাস হওয়া প্রয়োজন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। এখানে সাধারণ মানুষকে বরাবরই উপেক্ষা করা হয়েছে। আলোকচিত্রীরা বরং থাকেন সাধারণ মানুষের কাছাকাছি। তাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের গল্প তুলে ধরেন ক্যামেরায়। এই ছবিগুলো ক্ষমতাবানদের বার বার প্রশ্নের মুখোমুখি করে। ফলে আলোয় যারা সময়কে ধরেন, তাদেরকেই আমার সঠিক ইতিহাস নির্মাতা মনে হয়।

কিছু মন্দ দিক আছে ফটোগ্রাফির। প্রথমত এই পথটা খুব সহজ নয়। পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনরা বিষয়টিকে সহজভাবে নেয় না। আলোকচিত্রীদের ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা কম। তাই না বুঝে নেগেটিভ মন্তব্য করে থাকেন। অনেকের ধারণা, যে কোনো কাজ পায় না, সে করে ফটোগ্রাফি। কেউ এ পেশায় আসতে চাইলে স্বজনরা ভাবেন, সব বোধ হয় গোল্লায় গেল। এখন এই ধারণার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশের শিল্পকলা একাডেমীতে আলোকচিত্র বিভাগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর কোনো ফ্যাকাল্টি কিংবা আলাদা ইনস্টিটিউট নেই। শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোতেও ফটো এডিটরের কোনো পদ নেই। যে পেশার গুরুত্ব এত, সে পেশার রাষ্ট্রীয় তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই।

ফটোগ্রাফি একটি সৃজনশীল পেশা। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে লেখা যত না শক্তিশালী, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছবি; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশে। আগেই বলেছি, ছবি সর্বজনীন ভাষা। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে ছবি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। যিনি ছবি তোলেন, তিনি ওই ছবির মধ্যেই আছেন। ঘটনার সাক্ষী তিনি। কিন্তু ছবিতে তাকে দেখা যায় না।

‌@সাহাদাত পারভেজ একজন আলোকচিত্রী, লেখক ও আলোকচিত্রকলার পরামর্শক। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ চিত্রসাংবাদিক।

One thought on “হতে চাই আলোকচিত্রী – সাহাদাত পারভেজ

Leave a Reply