“ছবির গল্প বোনা”- হাফেজা আফরিন (ফটো স্টোরি)

এক যে ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনা টুনি গাছের উপর তাদের ছোট্ট বাসায় থাকে…………………………।। এভাবেই  আমরা গল্প বলি। কিন্তু একটি ছবি দিয়ে যখন একটি গল্প বলতে হয় তখন? সেটা নির্ভর করে আমরা গল্পের কতটুকু বলতে চাই , কিভাবে বলতে চাই কিংবা ছবির যে সব মৌলিক  উপাদান থাকতে হয় তা দিয়ে ছবি কে সাজিয়ে। যা একটি ছবির পুরনতা এনে দেয়। কিন্তু যখন কোন একটি গল্প কে কয়েকটি ছবির মাধ্যমে পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশ করতে চাই তখনি তাকে “ছবির গল্প” (ফটো স্টোরি) বলা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ও প্রতিটি ছবিই কোথা বলে একক ভাবে এবং সম্মিলিত ভাবে। ফটো স্টোরিকে অনেকে অনেক ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিন্তু সেসব ব্যাখ্যা না করে আমি আপনাদের জানাতে চাই একটি “ছবির গল্প” তৈরিতে আপনাদের কি কি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ কোন ধরনের ছবির মাধ্যমে একটি গল্প ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, যারা বেশ কিছু ভালো ছবি তুলে এরপর গল্প লিখতে চেষ্টা করেন এবং এভাবেই ফটো স্টোরিতে করা সম্ভব বলে দিঢ় ভাবে বিশ্বাস রাখেন তাদের এই লেখা না পরলেও চলবে। এ লেখা তাদের জন্য যারা জানতে চাইছেন আসলে কিভাবে একটি ফটো স্টোরি গাঁথতে হয়। আবার আমাকে মহাজ্ঞানী ভাবলেও ভুল হবে আমি এই সব জেনেছি শাহ্‌ সাজ্জাদ হসাইন (Photo Lounge ) স্যার থেকে। উনার অনুমতিক্রমেই তাঁর কাছ থেকে শেখা বিষয়টি নিজের ভাষায় আপনাদের বলছি।

একটি ছবি দেখার সাথে সাথে কিছু প্রশ্ন মাথায় আসে, তা হলো ছোটবেলায় শেখা সেই প্রশ্নগুলো,

১। কে? (who?)

২। কি? (what?)

৩। কখন? (when?)

৪। কোথায়? (where?)

৫। কেন? (why?)

৬। কিভাবে? (how?)

যখন প্রতিটি ছবি এই সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে একত্রিত ভাবে স্টোরির সব কয়টি ছবি সম্পূর্ণ গল্প দর্শকদের বুঝাতে পারে তাই হল ‘ফটো স্টোরি’। এখন প্রশ্ন আসে “একটি ফটো স্টোরি তে আমি কিভাবে ছবি নির্বাচন করে সাজাতে পারি?”, এ প্রস্নের উত্তরে বলা যায় আপনি যদি এই লেখায় আলোচিত বিষয়গুলো কে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে ছবি তুলতে চেষ্টা করেন এবং এই ৮ টি মূলভাব ফটো স্টোরিতে খুঁজে পাওয়া যায় তবে আপনার ফটো স্টোরি নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারবেন। আমি সন্তুষ্ট আমার প্রথম ফটো স্টোরি নিয়ে। যে ফটো স্টোরি করার সময় আমি জেনেছি কিভাবে তা করতে হয়। তবে এখানে আমার করা ফটো স্টোরি দিয়ে নয় প্রিয় ছোট ভাই “রাকিব মাহমুদ” এর করা ফটো স্টোরির ছবি ব্যবহার করেছি। “ফটো স্টোরি” এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন “একটি গল্প” যা আপনি আপনার ছবির মাধ্যমে বলতে চাইছেন। এক্ষেত্রে গল্প বলার জন্য আপনি উপন্যাস লিখতে পারবেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ছোট গল্পের মতো “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” হতে হবে। এমন একটি গল্প যার মাধ্যমে আপনি গল্পের ধারাবাহিকতায় নিজের মতামতও দিবেন। এমন ভাবে যাতে এর রেশ দর্শকের মনে ছাপ ফেলতে পারে। বাসায় যেতে যেতে ও একটু হলেও ভাবে।

উদাহরন: রাকিব গল্পটি বলেছিল এভাবে “ প্রায় ৭০ বছর বয়স লুৎফর রহমান। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ওনার পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালীতে বর্তমানে খুলনায় থাকেন। খুলনা নিউজপেপার মিলে প্রথম কাজ শুরু করেন। ২০০২ সালে রাজনৈতিক কারনে মিল বন্ধ হওয়ার পর তিনি চাকরি হারান। ২০০২ সাল থেকে লঞ্চের সারেং হিসাবে নিয়জিত আছেন। এখন তিনি চট্টগ্রাম জোনে তেল সরবরাহের কাজে নিয়োজিত আছেন। ছেলে চট্টগ্রামে সিইউএফএল এ রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করছেন। এক মেয়ে ইন্টার ১ম বর্ষে পড়ে এবং ছোট মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। দুই মাস অন্তর বাড়ি থেকে ঘুরে আসেন। পরিশ্রমী এই মানুষটি পরিশ্রম করতে পছন্দ করেন । তাই ছেলের বারণ করা সত্বেও নিজেকে কাজের মধ্যে নিয়োজিত রেখেছেন। তারমতে ঘরে বসে থাকলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন নদীর বুকেই তাঁর সব। লঞ্চের ছোট গন্দিতে তাঁর জীবন বাধা এবং বাকী জীবন স্বচ্ছ সাদামাটা ভাবে নদীতে ভেসে কাটাতে চান ”। পাঠকরা লক্ষ্য করবেন গল্পটি লেখার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাবজেক্ট এর পরিচয় বর্তমান অবস্থা এবং ব্যাক্তিত্ব । ভবিষ্যতের অনির্দিষ্ট তাঁর ভীরে ও কিন্তু তিনি তাঁর সক্বীয়তা হারান নাই। এটাই হতে হবে একটি ফটো স্টোরি এর মূল গল্প লেখার উপাদান। এবার আসি ছবির প্রসঙ্গে এবং সেই ৮ টি মূলভাব যা একটি “ফটো স্টোরি”  তে থাকা বাঞ্ছনীয়। ধারাবাহিকতা টি ছবি সাজানোর ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য।

১. Introductory or Overall : এটাকে সূচনা ছবি ও বলা হতে পারে। এক্ষেত্রে ছবিটি বিস্তৃতভাবে হতে হবে। আপনার বিষয়বস্তু (subject) এবং তার পারিপার্শ্বিকতার একটি পূর্ণ ধারণা ফুতে উঠে এমন ছবি।

ছবি – ১ রাকিব মাহমুদ

এই ছবিতে গল্পের মুল মানুষটির নিজস্ব পরিবেশের ছবি এবং তার পরিচিতি প্রকাশ করা হল। এতে আপনি প্রথম বারের মতো এই মানুষটির মুখমুখি হলেন। আপনার আগ্রহ হল তার সম্পর্কে জানবার।

২. Medium: এক্ষেত্রে subject এর নিজস্ব অথবা প্রাসঙ্গিক কিছু কার্যক্রমের ছবি। এখানে উনি কিছু একটা করছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উনি তরকারি কাটছেন। এখানে আমরা এখনো সাবজেক্ট এর পরিচয়ের দিকটি দেখছি না। কিন্তু ছবির পরবর্তী ধাপের জন্য আগ্রহ বাড়ছে। পাঠকরা এটাই কিন্তু ফটো স্টোরীতে দর্শক ধরে রাখার কৌশল।

ছবি-২ রাকিব মাহমুদ

৩.  Close-up: Subject এর নির্দিষ্ট কোন একটি অংশের উপর Close up shot নেয়া। যেমন যদি আপনি কোন ফুটবলার কে আপনার Subject হিসেবে বেছে নেন আপনার এই ছবিটি হতে পারে তাঁর পায়ের সাথে ফুটবলের একটি Close up । অথবা বিষয়বস্তুর সাথে তার পরিবেশের সাথে মিলিয়ে ছবি। এখানে ছবির মানুষটি নামাজ পড়ছেন। লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটি একটি লঞ্চের ছাদ। এভাবে ধীরে ধীরে মানুষটির পরিচয়ের ধাপ শুরু হল।

ছবি-৩ রাকিব মাহমুদ

৪. Portrait: এক্ষেত্রে Subject কে তার পরিবেশে (environment) একটি tight head shot  অথবা বিশেষ কোন মুহূর্তের ছবি।  এই ছবিতে প্রথমবারের মতন আমরা জনাব লুৎফর রহমানের সাথে সরাসরি পরিচিত হলাম।

ছবি-৪ রাকিব মাহমুদ

৫. Interaction: Subject এবং তার পরিবেশে (environment) যে সকল মানুষের অবস্থান তার ছবি। যদি আপনার subject কোন মানুষ হয় তবে সে তার পাশের মানুষের সাথে কথা বলা বা অন্য কোন কাজের ছবি, অথবা আপনার subject যদি গাছ হয় তবে সেই গাছের নিচে বসে থাকা মানুষের ছবিও হতে পারে।  লক্ষ্য করবেন এই ছবিতে উনার একটি নতুন সব্যসাচী দিক কিন্তু আমরা দেখতে পাই । একি সাথে গোসল করার সাথে সাথে উনি একজনের সাথে কথা ও বলছেন।

ছবি-৫  রাকিব মাহমুদ

৬. Signature (The Decisive Moment): এই ছবিই হল মূলভাব যা বলতে চাইছেন আপনার ছবির গল্পে। আশা-নিরাশা, ভাললাগা-মন্দলাগা আপনার photo story এর সারমর্ম ফুটিয়ে তুলবেন এই পর্যায়ে, একটি ছবিই হবে আপনার গল্পের প্রান। এখানে তিনি একা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমনটি তার আসল বেক্তিত্ত ।

ছবি-৬ রাকিব মাহমুদ

৭. Sequence: এ ধাপে photo story এর সূচনা , মাঝের এবং শেষ এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কয়েকটি ছবি।  সাবজেক্ট এর নিজের কিছু কার্যকলাপের পাশাপাশি উনার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ও আমরা ধারণা পাই এসব ছবিতে।

ছবি-৭ রাকিব মাহমুদ

ছবি-৮ রাকিব মাহমুদ

৮. Clincher: এই ছবিটি দিয়ে আপনার photo story টি শেষ হবে। গল্পের উপর নির্ভর করবে আপনি কিভাবে সমাপ্তি চাইছেন। এখানে তিনি উঠছেন বা নামছেন সেটা নয় বরং তার জীবন এভাবেই চলমান এটাই বোঝানো হল। শেষের পরও কিছু যেন বাকি রইল।

ছবি-৯ রাকিব মাহমুদ

উপরের আলোচিত বিষয়গুলো দিয়ে একটি photo story  সাজানো যায় খুব সহজেই। কিন্তু তবু ও এটি খুব সহজ কোন বিষয় নয়। উদাহরন হিসাবে যে ছবির গল্প টি দেওয়া হল তাতে লক্ষ্য করবেন কোন ছবিতে ফটোগ্রাফির যে সকল মৌলিক উপাদান দরকার তা রয়েছে। তবে প্রতিটি ধাপে আপনাকে অনেক সময় দিতে হবে , জানতে হবে subject কে অনেক গভীর ভাবে। এবং তার (যদি বিষয় টি মানুষ হয়) সম্পরকে অথবা যদি অন্ন কিছু আপনার বিসয় হয় তবে তা সম্পর্কে তথ্য জানতে হবে। যত বেশি তথ্য আপনি জেনে নিতে পারবেন ততই আপনি বিষয়বস্তুকে নতুন দৃষ্টিতে দেখবেন। যদি হুটহাট কিছু ছবি তুলেই গল্প সাজাতে শুরু করেন তাহলে অনেক ভুল তথ্যের শিকার হবে আপনার photo story টি। যা আলোকচিত্রশিল্পী (photographer) হিসেবে ethics এর বিরোধী।

সচেতনতার সাথে সময় নিয়ে ধৈর্য সহকারে যদি একটি ছবির গল্প (photo story) তৈরি হয় তবে তা photo story হিসেবে অনেক strong হবে।

যারা photo story নিয়ে আগ্রহী তারা অনেক সময় নিয়ে কাজটি করবেন এই প্রত্যাশা রইল। হ্যাপি ক্লিকিং।

5 thoughts on ““ছবির গল্প বোনা”- হাফেজা আফরিন (ফটো স্টোরি)

Leave a Reply