বিংশ শতাব্দীতে সাড়া জাগানো আমেরিকান আলোকচিত্রীদের মধ্যে এডওয়ার্ড অয়েস্টন (১৮৮৬ – ১৯৫৮) পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত। তার বিমূর্ত স্টিল-লাইফ সিরিজ গুলো সেই সময়ে আলোকচিত্রে নতুন মাত্রায় দৃশ্যায়ন করার সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। এই ধারায় দৃশ্যায়িত ক্লোজ-আপ ছবিগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ মরিচের (Pepper No. 30, c. 1930) প্রতিরূপ এমনই এক বিমূর্ততায় ধরা দেয় যা কি’না পরাবাস্তব ফর্মের সাথেই তুলনা চলে। প্রথম দর্শনে ছবিটিকে দেখলে মনে হবে এটি ব্যায়ামবিদের শরীর; কাঁধের উপর বাহুর জোড়ালো প্রক্ষেপণ। মস্তকবিহীন একটা মানুষ তার শারীরিক শক্তি প্রদর্শনে মগ্ন অথবা তিনি একজন কুস্তিগির – তার মুষ্টিবদ্ধ হাত ঔদ্ধত শক্তির সমরে সদা প্রস্তুত । সাদাকালো এই ছবিটির পরিসর (Space), কন্ট্রাস্ট, আলোর প্রক্ষেপন, বস্তুর দেহের ভঙ্গিমা একটি বিশেষ কোণ হতে গৃহিত হবার ফলেই মরিচের ফর্মটি এতো বিমূর্ত।
বিমূর্ত চিত্রকলার মতন, আলোকচিত্রে বিমূর্ততার দর্শন একই তত্ত অনুসরন করে। শিল্প আন্দোলন গুলোর সেই প্রারম্ভ হতে তৎকালীন সভ্যতা, আবিষ্কার তদুপরি দর্শনের প্রগতির সাথে সাথে একাত্ম হয়ে বিকশিত হয়েছে শিল্প-সম্ভার। আলোকচিত্রে বিমূর্ততার চর্চা বিকাশমান শিল্প পরিক্রমার একটি অংশ মাত্র। এই ধাবমান শিল্পের ভাষা ক্রমশঃ পরিবর্তনশীল। বিমূর্ত শিল্পের ভাষা দৃশ্যমান বাস্তবতার বিপরীত, এখানে অর্ন্তঃনিহিত নিগূড় তাৎপর্য লুকায়িত থাকে দৃশ্য-ভাবের আড়ালে। আর এই ভাবের জগতে অবগাহনের আহ্বান আলোকচিত্র শিল্পীদের মাঝেও প্রবাহমান।
অয়েস্টনের ভেতর ভিন্ন ভাবে একটি বস্তুকে দেখবার যেমন প্রবণতা ছিলো, তেমনি ছিলো আলোকচিত্রে সেটাকে দেখানোর একটি সূক্ষ পদ্ধতিগত ধারনা। বিমূর্ত চিত্রকলা সেই রেনেসাঁর সময় থেকে প্রাসংগিক যুক্তি ধারা মেনে চলে। বাস্তব অবস্থাকে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশনার মাধ্যমে এক প্রকার ইলুশন (Illusion) তৈরী করাই এর উদ্দেশ্য। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কিউবিজম (Cubism) শিল্পধারার প্রধানতম প্রবক্তাদের ভেতর জর্জেয ব্রুক (Georges Braque) ও পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso) চতুর্মাত্রার সময়কে বিমূর্ত চিত্রকলায় উপস্থাপন করে। পরবর্তিতে ফিউচারিজম (Futurism) শিল্পধারও বিমূর্ত আবহকেই ধারণ করে। আলোকচিত্রে ডবল এক্সপোজার (Double Exposure) কিউবিজম ধারণার প্রারম্ভ থেকেই প্রতীয়মান ছিলো আর পিকাসো এ সম্পর্কে ছিলো অবগত। বিমূর্ততার প্রকাশ আলোকচিত্রে সেই প্রথম কাগজে মুদ্রিত টিকে থাকা প্রিন্ট “View from the window at Le Gras, c. 1826 or 1827” নিজেই একটি বিমূর্ত আলোকচিত্র জোসেফ নিসফোর নিপসের (Joseph Nicéphore Niépce)।
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের আলোকচিত্রীদের ভেতর আন্দ্রেয়াস গার্স্কির (Andreas Gursky) নাম সুপরিচিত। তার আলোকচিত্রের শৈলী মানবজাতি তথা সামাজিক পদ্ধতি (Social System) এবং এর ক্রিয়া-বিন্যাসকে সাদৃশ্যপূর্ণ (Symmetrical) বিমূর্তে প্রকাশ করে। শিল্পবিপ্লব গুলোর আঁচ আলোকচিত্রে পরিষ্ফুটন হতে সময় নেয় কেননা রিয়ালিজম ধারার আলোকচিত্রীর সংখ্যাধিক্য শুধু জিবীকার তাড়নার কারণে, প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অধরা থেকে যায় শিল্প শেখার তাড়না। গার্স্কির তার Cocoon II, c. 2008, C-Print, 43.2 x 83.9 cm ছবিতে ককুন নাইট ক্লাবের দৃশ্য ধারণ করে, সেখানকার ওয়ালটি ত্রিমাত্রিক কম্পিউটারে তৈরী, ছবিটি অনেকাংশই স্টুডিওতে ধারণকৃত এবং পরবর্তিতে ডিজিটালি সারাইকৃত। গার্স্কির এসব ছবি উত্তর-আধুনিকতাবাদ ও আবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশানিজম ধারার এক সম্মিলন।
প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের একটি নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকে, আলোকচিত্র নিজেও এর ব্যাতিক্রম নয়। দৈনন্দিন জীবনের বিমূর্ত চিত্র খুব সহজে না হলেও ক্যামেরায় ধারণ করা কঠিন কিছু নয়, যতটা কঠিন একে একটি অর্থবোধক চিত্র করে তোলা। শিল্পীকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয় – এসবের ভেতর থেকে আসে শিল্পের উপাদান – নতুন করে ভাবার প্রবণতা – সৃষ্টি হয় আখ্যান, তৈরী হয় স্টাইল। চিত্রটি মূর্ত হোক আর বিমূর্ত যা ই হোক এতে সরস উপাদানের ঘাটতি হলে, যদি এটি সমকালিন নতুন ধারণার কথা না বলে, তবে শিল্প রসিকদের বাহবা থেকে যেমন এটি বঞ্চিত হয়, তেমনি শিল্পবোদ্ধাদের তারিফ অপ্রাপ্ত থেকে যায়। বিমূর্ত আলোকচিত্র শিল্পের একটি শাখাই শুধু নয়, ভাবনার উৎর্কষতা নিরূপণের নান্দনিক মধ্যমও বটে।